কখন এবং কীভাবে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা শুরু করবেন

ড. কে এম আতিকুর রহমান
ড. কে এম আতিকুর রহমান  © টিডিসি ফটো

সফল ক্যারিয়ার প্লানিং হচ্ছে কঠোর পরিশ্রমের শামিল। পেশাগত সাফল্যের অর্ধেক নির্ভর করে সফল ক্যারিয়ার প্লানিং-এর উপর। আমাদের তরুণরাও প্ল্যান করে; কিন্তু কঠিন সত্য হলো, প্ল্যান আর বাস্তবতার মধ্যে মিল হয় কম ক্ষেত্রেই। এখানে শিক্ষা ও ইন্ডাস্ট্রির লিংক নেই বললেই চলে। চাহিদার তুলনায় কর্মসংস্থানের যোগান খুবই কম। ভাগ্য মানুষকে তখনই সহায়তা করে যখন একজন মানুষ থাকে পরিকল্পিত ও প্রস্তুত। 

উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পরই একজন তরুণকে ক্যারিয়ার প্ল্যান করতে হয়। অর্থাৎ চাকরি খোঁজা শুরু হওয়ার চার বছর আগেই ক্যারিয়ার গোল সেট করতে হয়। ক্যারিয়ার প্ল্যান হবে তিন ধরনের: স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী। আমাদের সমাজে কারো কারো জন্য এই প্ল্যানটা হওয়া উচিৎ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই। যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় এবং যাদের উচ্চ-মাধ্যমিক পাসের পরই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করার প্রয়োজন হয়, তাদের জন্য এটা করা দরকার।

ক্যারিয়ার গোল সেট করতে হবে আগ্রহ, দক্ষতা ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে। প্রতিদিন যে ক্যারিয়ারটার কথা মাথায় সবচেয়ে বেশী আসে, যার কথা ভাবতে উত্তেজনা বোধ হয় সেটাকে আগ্রহ বলা হয়। সোস্যাল মিডিয়া, পত্র-পত্রিকা, ওয়েবপেজ দেখামাত্র যে প্রফেশন আনন্দ দেয়, দেখতে ও পড়তে ভাল লাগে তাকে আগ্রহ বলা হয়। কেউ শিক্ষক হতে চাইলে শিক্ষকতার কথা শোনামাত্র তার আগ্রহ জন্মাবে কিছু জানার জন্য; আসলে এটাই আগ্রহের বাস্তব উদাহরণ।

দক্ষতা হলো ক্যারিয়ার প্লানিং-এর দ্বিতীয় উপাদান। আগ্রহ আছে শিক্ষক হওয়ার কিন্তু কাউকে পাঠদানের বা শিক্ষাদানের কোন দক্ষতা না থাকলে শুধু আগ্রহটা ক্যারিয়ার প্লানিং-এর জন্য যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ, পেশা খোঁজার সময়ে বা আগেই যে কাজের ন্যূনতম দক্ষতা আছে তা-ই হতে পারে মোক্ষম ক্যারিয়ার গোল। যে কাজের দক্ষতা নেই সে কাজ ভবিষ্যতে ভাল ফল দেয় না।  জিনগতভাবে অথবা শৈশবকাল হতে ঐ কাজটার মূল্যবোধ তার অর্জিত হয়নি। আগ্রহ ও ন্যূনতম দক্ষতার ভিত্তিতে ক্যারিয়ার প্ল্যান সাজালে ঐ কাজটা জোগাড় করা যেমন সহজ, পরবর্তীতে সফল হওয়াও সহজ। ক্যারিয়ার প্ল্যানটা কাজ পাওয়ার সাথে সাথেই কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। পেশাগত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্লানিং অব্যাহত রাখতে হয়। কাজ পাওয়ার জন্য ও কাজে ভাল করার জন্য অথবা পেশা পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন মেয়াদের ক্যারিয়ার প্ল্যান প্রয়োজন হয়। 

আগ্রহ ও দক্ষতার সামঞ্জস্যপূর্ণ মিল হলে মূল্যবোধের প্রশ্নটা চলে আসে। শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ ও দক্ষতা থাকলে এ পেশার মূল্যবোধ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখা প্রয়োজন। মূল্যবোধ বলতে কাজের দায়িত্ব, প্রকৃতি, আয়, সামাজিক মর্যাদা, শ্রম ঘণ্টা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়। মূল্যবোধ বোঝার জন্য কোম্পানি, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইল সম্পর্কে জানতে হবে। কোম্পানির ওয়েব পেজ, সোস্যাল মিডিয়া, প্রেস রিলিজ ও অফিসিয়াল প্রতিবেদন হতে কোম্পানির মূল্যবোধ জানা সম্ভব। প্রত্যেকটি কোম্পানির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতি আলাদা হয়ে থাকে। বিভিন্ন কোম্পানির প্রোফাইল জানার পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের মনে একটি ইউনিক মূল্যবোধ তৈরি হবে। আগ্রহ, দক্ষতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টির সময়ে নিজেকে ফ্লেক্সিবেল রাখতে হবে। ভিন্ন ও পরিবর্তিত মূল্যবোধে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করা দরকার। একটি জায়গাতে রিজিড থাকলে ক্যারিয়ার প্লানিংটা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। সময়, কাজের ধরন ও প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। 

আগ্রহ, দক্ষতা ও মূল্যবোধ জানা হয়ে গেলে চূড়ান্তভাবে একজন তরুণ তার ক্যারিয়ার গোল সেট করতে পারবে। গোল সেট হয়ে গেলে তা অর্জন করার জন্য অ্যাকশন প্ল্যান শুরু করতে হবে। অ্যাকশন প্ল্যান হবে স্বল্প মেয়াদী, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী। পরিকল্পিত বিষয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া স্বল্প মেয়াদী প্লানের অংশ। এখানে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ভর্তির কথাই বলা হচ্ছে। কোর্স সিলেকশন, ক্লাস ও এ্যাসাইনমেন্ট-সকল ক্ষেত্রেই ক্যারিয়ার গোলের কথাটা মাথায় রাখতে হবে। মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনাটা হবে এক হতে দুই বছর মেয়াদী। আন্ডারগ্রেড পড়ার সময়ই এই মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলতে থাকবে। ক্যারিয়ার গোলের উপর দুই হতে পাঁচটি সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করা দরকার। কোর্সগুলো যথাসম্ভব অনলাইনে সম্পন্ন হওয়া ভাল যাতে মূল শিক্ষা প্রোগ্রামে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। ইন্টার্নশিপ ও ভলান্টিয়ারিং এক্টিভিটিগুলো হবে মধ্য মেয়াদী অ্যাকশন প্লানের অংশ।

পেশা খোঁজা শুরু হওয়ার একবছর আগেই জব সাইট বা ক্যারিয়ার সাইটগুলো পর্যালোচনা করে আবেদনের যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একটি চেকলিস্ট করে ফেলতে হবে। আন্ডারগ্রেড প্রোগ্রাম শেষ হতে না হতেই কাগজপত্রগুলো প্রস্তুত করে ফেলা দরকার। প্রয়োজন অনুযায়ী শর্ট অথবা ডিটেইল্ড সিভি প্রস্তুত করতে হবে। একাডেমিক ও কর্পোরেট জবের জন্য সিভি হবে ভিন্ন। সহজ কথায়, সিভি হয়ে থাকে পাঁচ-ছয় ধরনের। প্রয়োজন অনুসারে এটার প্রয়োগ করা প্রয়োজন হয়। সিভি তৈরি করার অনেক ভাল ভাল সফটওয়্যার আছে, যা ব্যবহার করে নিজেই তা তৈরি করা সম্ভব। সুন্দর একটা কাভার লেটার সিভির সাথে সংযুক্ত করতে হয়। 

যেকোন পেশার এন্ট্রি লেভেলেই যোগদান করা উচিৎ। মিড লেভেল পদে যোগদান করলে বাস্তব দক্ষতার কিছুটা হলেও গ্যাপ থেকে যায়। কাজে যোগদান করার পর শুরু হবে ১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদী ক্যারিয়ার প্ল্যান। এই মেয়াদে কোন কোন দক্ষতা ও প্রযুক্তি শেখা দরকার তার একটা চেকলিস্ট করা দরকার। পাঁচ-সাত বছরের আগে পেশা পরিবর্তন করা কারোরই উচিৎ নয়। পেশা পরিবর্তন করলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কাজে যাওয়া একেবারেই অনুচিত। শিক্ষকতা হতে ব্যাংকিং জবে যাওয়া উচিৎ নয়। শিক্ষকতা হতে গবেষণা পেশায় যাওয়া যেতে পারে।

শটকার্ট ওয়ে, অসততা ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে পুরো ক্যারিয়ার প্ল্যানটাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। হ্যাঁ, আমাদের সমাজে অসততা ও দায়িত্বহীনতা অনেক ক্ষেত্রেই ক্যারিয়ার প্লানের মূল উপাদানে পরিণত হয়েছে। তদবির ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নানা পদ বাগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। মনে রাখা দরকার, শুধু পদ-পদবি আর আয়-রোজগারের জন্য ক্যারিয়ার প্ল্যান নয়। ক্যারিয়ার প্ল্যান মূলত দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা এবং দেশের জন্য সাধ্যমতো কাজ করা। এগুলোর যৌক্তিক ফলস্বরূপ অর্থ ও পদ-পদবি আসবে এবং আসবে সম্মান ও মর্যাদা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence