সরকারের দ্বিগুণ বাজেটেও শিক্ষার্থী কমছে কারিগরি শিক্ষায়

কারিগরি শিক্ষা বোর্ড
কারিগরি শিক্ষা বোর্ড  © সম্পাদিত

মুখস্থ নির্ভর ও গৎবাঁধা পাঠ্যসূচির প্রচলিত শিক্ষা ধারার বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে দক্ষ করতে দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অগ্রাধিকারভুক্ত করে সরকার। চলমান শিক্ষা মাধ্যমে সরকারের কারিগরি শিক্ষার এ উদ্যোগের মধ্যে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত এবং এর মধ্যেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফল অংশীদার হতে দক্ষ ও প্রযুক্তি নির্ভর মানবসম্পদ গড়তে প্রতিনিয়ত বাজেট বাড়ানো হচ্ছে দেশের কারিগরি এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা খাতে। 

তবে সরকারের ক্রমবর্ধনশীল অর্থায়ন এবং উদ্যোগ থাকলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না দেশের কারিগরি শিক্ষায়। দেশে প্রতিবছরই ক্রমান্বয়ে কমছে কারিগরি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার (এনরোলমেন্টে) বর্তমানে ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ হলেও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এ হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে অর্থায়ন বৃদ্ধি করছে।

দেশের কারিগরি শিক্ষার তদারক সংস্থা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের কারিগরি শিক্ষার ডিপ্লোমা স্তরে সরকারের খরচ হয়েছে ১৫০ কেটি ৬৯ লাখ ৬৩ হাজার ৮শ’ ৬৮ টাকা এবং বিপরীতে ব্যয়িত শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৯১ হাজার ২৬ জন। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে কারিগরি শিক্ষায় সরকারের খরচ হয় ৭৬ কোটি ৯৩ লাখ ৩৮ হাজার ৩শ’ ৯১ টাকা এবং বিপরীতে ব্যয়িত শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১২০ জন।

আমাদের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও যুগোপযোগী করতে হলে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সতর্কতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে—সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে: অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান

দেশে কারিগরি শিক্ষায় বিগত পাঁচ বছরে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ৭৩ কোটি ৬৬ লাখ ২৫ হাজার ৪শ’ ৭৭ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় সরকারের ব্যয় হয়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি অর্থ; বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার কথা থাকলেও তাতে ধস নেমেছে বিগত বছরগুলোতে।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বলছে, দেশে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ডিপ্লোমা স্তরে শিক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১২০ জন। সবশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার ২৬ জন। এর আগে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ লাখ ৬ হাজার ৪শ’ ১৮ এবং ৯৩ হাজার ৩ শ’ ৯ জন। অর্থাৎ বিগত পাঁচ শিক্ষাবর্ষে দেশে কারিগরির ডিপ্লোমা স্তরে শিক্ষার্থী কমেছে ২০ হাজার ৯৪ জন। এ সময়ের মধ্যে সরকারের দ্বিগুণ ব্যয়েও বাড়েনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অথচ সরকার আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার (এনরোলমেন্টে) ৩০ শতাংশে উন্নীত করার বিশেষ পরিকল্পনা করছে।

এছাড়াও শিক্ষার্থী কমছে কারিগরির মাধ্যমিক স্তরেও। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরে ২ লাখ ৭শ’ ৬৩ জন শিক্ষার্থী থাকলেও সর্বশেষ ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা কমে দাড়িয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫শ’ ৬৪ জনে। তবে, দেশের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমিক ও উচ্চস্তরে শিক্ষার্থী কমলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ২ লাখ ৭ হাজার ৩৮৪ জন শিক্ষার্থী থাকলেও সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৯শ’ ৫ জনে।

কারিগরি শিক্ষা নিয়ে দেশের মানুষের সচেতনতা ও আগ্রহ বাড়াতে আমরা সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এছাড়াও আমাদের চলমান প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের কারিগরি শিক্ষাখাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করছিচেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।

দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সরকার অনুমোদিত নীতিমালা অনুসারে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক শৃঙ্খলা, ভৌত সুযোগ-সুবিধা, যন্ত্রপাতির পর্যাপ্ততা ও কোর্স বাস্তবায়নের পরিবেশ নিশ্চিত কল্পে পরিদর্শন, মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণসহ প্রতিবেদন প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিশেষায়িত এ শিক্ষা খাতের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা থাকলেও তাতে খুব বেশি দক্ষতা দেখাতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। ফলে দেশের কারিগরি শিক্ষায় ক্রমান্বয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দেশে ০৪ বছর মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাগ্রিকালচার, ফিশারিজ, ফরেস্ট্রি, লাইভস্টক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ও ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (নেভাল) ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (আর্মি) এবং ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালিত হচ্ছে এবং যা তদারক করছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এছাড়াও ‘জাতীয় দক্ষতামান’ (বেসিক ৩৬০ ঘণ্টা) নিয়েও তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি শিক্ষাক্রম পরিচালনা করছে বিশেষায়িত শিক্ষা বোর্ডটি।

দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে পুরাতন কারিগরি শিক্ষা আইন, ১৯৬৭ (১৯৬৭ সনের ০১ নং আইন) রহিত করে যুগোপযোগী বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৬৬ নং আইন) প্রণয়ন করে সরকার। বর্তমানে দেশের ‘১০০টি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন’—নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ ও চলমান আছে। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে আরও ৩২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপন—প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। দেশে ইতোমধ্যে স্থাপিত টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। যার মধ্য দিয়ে দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় সরকার।

কারিগরি শিক্ষায় বিগত পাঁচ বছরে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ৭৩ কোটি ৬৬ লাখ ২৫ হাজার ৪শ’ ৭৭ টাকা। এ সময়ের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় সরকারের ব্যয় হয়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি অর্থ; বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার কথা থাকলেও তা কমেছে শিক্ষা মাধ্যমটির উচ্চ মাধ্যমিক স্তর বাদে সব স্তরে।

বোর্ড বলছে, দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী জনসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে তাদের অধীনে বর্তমানে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাক্রম ভিত্তিক মোট ১০ হাজার ৮৫৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৩০ জন শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। বোর্ড দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কোর্সের কারিকুলাম প্রণয়ন, পরিমার্জন, মান উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রদান, পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদায়নের কাজও করছে তারা। তবে, তাদের এসব কাজের ফলাফল খুব আশাব্যঞ্জকভাবে দেখা যায়নি বিগত বছরগুলোতে।

এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, কভিড-১৯ মহামারি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষ শিক্ষার্থী তৈরি করতে না পারা এবং সনদ নির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থী কমতে পারে। তবে সংখ্যার হিসেবের বাইরে গিয়ে দক্ষতা বিচারে যদি মানদণ্ড বজায় রাখা যায়, তাহলে তা দেশের কারিগরি শিক্ষায় খুব বেশি প্রভাব না বলেও মনে করেন তিনি।

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক বলেন, আমাদের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও যুগোপযোগী করতে হলে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সতর্কতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে—সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সাথে এ খাতে বাজেট বৃদ্ধির ফলে তা যেন নামমাত্র প্রতিষ্ঠান বা কাজের পেছনে খরচ না হয় সেদিকেও সতর্কতা থাকার পরামর্শ তার।

বর্তমানে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাক্রম ভিত্তিক মোট ১০ হাজার ৮৫৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৩০ জন শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে—কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।

দেশের কারিগরি শিক্ষাখাতে শিক্ষার্থী কমার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খান জানান, আমরা কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার কারণে তাদের কোর্স বাতিল করা হয়েছে। যেহেতু কোর্স বাতিল করা হয়েছে, তাই শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে গেছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের যে উপবৃত্তি দেওয়া হতো, তা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে—বৃত্তি চালু করা হলে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়বে। এছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি না বাড়ার কারণেও শিক্ষার্থী কমছে বলে জানান তিনি।

বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, সরকারের ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা কাজ করছি। আমাদের চলমান প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের কারিগরি শিক্ষাখাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে আমরা আশা করছি। এছাড়াও কারিগরি শিক্ষা নিয়ে দেশের মানুষের সচেতনতা ও আগ্রহ বাড়াতে আমরা সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আমরা আশা করছি, অচিরেই কারিগরি শিক্ষায় আমরা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।


সর্বশেষ সংবাদ