ফোনে স্ক্রলিংয়ের ফাঁদ থেকে বের হওয়ার ৩ পরামর্শ

স্ক্রলিংয়ের আসক্তি
স্ক্রলিংয়ের আসক্তি  © সংগৃহীত

একটা ভিডিওতে কুকুরছানা, আরেকটায় সমুদ্রপাড়ের ছবি। কখনও মজার মিম, আবার কখনও ভিনদেশের খবর। সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রল যেন থামতেই চায় না। পছন্দ না হলে পাশ কাটিয়ে যাই, আবার কিছু ভালো লাগলে হারিয়ে যাই আরও কিছু ক্লিপে। অফিসে লিফটে ওঠার সময় হোক কিংবা ঘুমাতে যাওয়ার আগে — এই স্ক্রলিং এখন অনেকেরই নিত্যদিনের অভ্যাস।

কিন্তু এই স্ক্রলিং কেন এতটা আকর্ষণীয়? শুধু সময়ের অপচয়, না কি মস্তিষ্কের উপরেও এর প্রভাব পড়ে? কীভাবে এই অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং কিভাবে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব — এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে এসেছে নানা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।

লিডস বেকেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র লেকচারার এইলিশ ডিউকের মতে, ফোন হাতে নেওয়া এবং স্ক্রল করা এখন অনেকটাই স্বয়ংক্রিয় একটি আচরণে পরিণত হয়েছে। “এটা অনেকটা দরজা বন্ধ করার মতো, আমরা বুঝেই উঠি না যে কখন করলাম,” বলেন তিনি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যতটা মনে করে তার চেয়ে অনেক বেশি বার ফোন হাতে তোলে এবং স্ক্রল করে — এবং এই ব্যবধান ধরা পড়ে স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ে।

অন্যদিকে, স্মার্টফোনের অ্যাপ ডিজাইন এবং মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম বা পুরস্কার-ভিত্তিক কাজের প্রবণতার মাঝে তৈরি হয় একধরনের নিখুঁত যোগসূত্র। এনওয়াইইউ ল্যাংগনের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক আরিয়েন লিং মনে করেন, মানুষের সহজাত কৌতূহল এই স্ক্রলিংয়ের জ্বালানী হিসেবে কাজ করে। মানুষ জানতেই চায় — চারপাশে কী ঘটছে। আর স্মার্টফোন সেই তথ্য প্রবাহকে অবিরাম করে তোলে।

মস্তিষ্কের মধ্যে এমন একটি সিস্টেম আছে যা আনন্দ বা সুখানুভূতি পেলেই সেটি বারবার চাইতে থাকে। ঠিক যেমন যৌনতা, মাদক বা জুয়ায় আনন্দ পেয়ে কেউ আসক্ত হয়ে পড়ে, স্ক্রলিংয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম ‘ডোপামিন রিওয়ার্ড’ কাজ করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত যে ছবি, ভিডিও, বার্তা বা মন্তব্য আসে — তা মস্তিষ্ককে একের পর এক ক্ষণিকের আনন্দ দিয়ে যায়।

তবে, মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। কিন্তু যখন কেউ অতিরিক্ত স্ক্রলিংয়ের মধ্যে থাকে, তখন এই যুক্তিনির্ভর অংশটি দুর্বল হয়ে যায় — এবং মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়, কারণ তাদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এখনো পরিপক্ব নয়, অথচ রিওয়ার্ড সার্কিট খুব সক্রিয়।

অধ্যাপক ডিউক বলেন, দীর্ঘ স্ক্রলিংয়ের সময় মানুষ ‘ফ্লো স্টেট’-এ চলে যায়। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে যায়। টিকটকের মতো অ্যাপের অ্যালগরিদম বারবার এমন কনটেন্ট পরিবেশন করে যা ব্যবহারকারীর আগ্রহকে ধরে রাখে। ফলে, মানুষ দুই ঘণ্টা ধরে কুকুরের ভিডিও দেখেও বুঝতে পারে না সময় কীভাবে কেটে গেল।

অধ্যাপক লিং একে ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “যত বেশি আপনি কোনো পথে হাঁটবেন, সেটা ততটাই সহজ মনে হবে।” তেমনি, স্ক্রলিং নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হলে তা হয়ে যায় ‘ডিফল্ট এক্সপেরিয়েন্স’। তখন বই পড়া, ঘর গুছানো বা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো কাজগুলোতে মন বসানো কঠিন হয়ে পড়ে।

মনোরোগ চিকিৎসার ম্যানুয়ালে এখনও ‘সেল ফোন অ্যাডিকশন’ নামে কোনও নির্দিষ্ট রোগ নেই। তাই কোন পরিমাণ মোবাইল ব্যবহার স্বাভাবিক আর কোনটা নয় — সেটার নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। তবে, ফোনের ব্যবহার যদি জীবনের অন্য ক্ষেত্রগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তখনই ধরে নিতে হয় বিষয়টা উদ্বেগজনক।

এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায়ও রয়েছে। প্রথমত, নির্দিষ্ট সময় স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা — যেমন, ফোন ছাড়া হাঁটতে বের হওয়া বা ব্যায়ামে যাওয়া — মস্তিষ্ককে রিচার্জ করতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, ফোনের বিকল্প খুঁজে নেওয়া — যেমন, মোবাইলে সময় না দেখে ঘড়ি পরা, অফলাইনে পড়া বা বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি মিশে থাকা। তৃতীয়ত, ব্যবহারকারী নিজেই যদি সচেতন হয় এবং ফোন হাতে নেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করে — “আমি কেন এখন এটা তুলছি?” তাহলে অনেক সময় স্ক্রলিংয়ের তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ফোনের স্ক্রিনের পেছনে লুকিয়ে থাকা এই চক্র যতটা প্রযুক্তির, ততটাই মনস্তত্ত্বেরও। আর এর নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতেই — যদি আমরা চাই নিজেকে সামলাতে।


সর্বশেষ সংবাদ