নোবিপ্রবি শিক্ষক উর্বী
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দিন থেকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২২, ০৩:২৪ PM , আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২, ০৬:২৯ PM
কথায় আছে- ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। তেমনি একজন আফরিদা জিননুরাইন উর্বী। উর্বি মানে পৃথিবী। আর পৃথিবীর মতই বিশাল তার কর্ম পরিধি। গান, আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থাপনা, ছবি আঁকা, লেখালিখি সবক্ষেত্রেই তার বিচরণ। শুধু বিচরণ বললে ভুল হবে সবকিছুতেই পারদর্শী তিনি। এতকিছুর সাথে যুক্ত থাকলেও পড়ালেখার ব্যাপারে কখনো ছাড় দেননি। সাংস্কৃতিক চর্চা এবং পড়ালেখা একসাথে চালিয়ে নিতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তবু পড়াশুনার সাথে কখনো কম্প্রোমাইজ করেননি। আর তাইতো এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। গত মাসেই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়
উর্বীর জন্ম বরিশাল সদরে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। মা-বাব দুজনেই শিক্ষক। বাবা অধ্যাপক জাহিদ হোসেন বরিশাল সিটি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক। মা অধ্যাপক বিলকিস বানু বেগম একই কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। ছোট ভাই মানতাকা জুননুরাইন আদৃত চুয়েটে আর্কিটেকচারে ২য় বর্ষে পড়ে। এই নিয়ে ছোট্ট তবে সাজানো সংসার।
বরিশালের ওয়াইডাব্লিউসিএ স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে উর্বীর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৫ (বোর্ড বৃত্তি ট্যালেন্টপুল) পায়। বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ জিপিএ-৫ (বোর্ড বৃত্তি) এইচএইসসিতে উত্তীর্ণ হন।
স্কলারশিপসহ প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেও পরের বার আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বিষয় হিসেবে বেছে নেন অর্থনীতি। স্নাতকে অধ্যয়নকালে শিক্ষা অধিদপ্তর বৃত্তি ও গভর্নর স্কলারশিপ পেয়েছেন তিনবার। স্নাতকোত্তরে বিভাগে ৪র্থ ও গভর্নর স্কলারশিপ পেয়েছেন।
ছোটবেলাতেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হাতেখড়ি হয় তার। আড়াই বছর বয়সে প্রথম স্টেজ পারফর্ম করেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বরিশাল বেতারের কচিকাঁচার আসরের শিশু রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পাওয়ার পাশাপাশি ছবি আঁকায় বিভাগীয় পর্যায়ে হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন।
আরও পড়ুন: বিপক্ষে অধিকাংশ শিক্ষক, গুচ্ছে যাচ্ছে না জবি?
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবছরই জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় উপস্থিত রচনা, উপস্থিত বক্তৃতা ও রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি। এত দক্ষতার ভেতর উর্বীর শক্তির মূল জায়গাটি হলো বিতর্ক।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় দুর্নীতি দমন কমিশন আয়োজিত ‘আন্তঃস্কুল বিতর্কে’ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। দশম শ্রেণিতে টেলিভিশন বিতর্কে হয়েছেন শ্রেষ্ঠ বক্তা। দ্বাদশ জাতীয় টেলিভিশন বিতর্কের তিনি বারোয়ারি চ্যাম্পিয়ন। ছিলেন সুফিয়া কামাল হল ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (ডিইউডিএস) সহ-সভাপতির দায়িত্ব ও পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ থেকে শুরু হয় তার বারোয়ারি বিতর্কের জয়যাত্রা। বিশটির অধিক চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, পাঁচটি রানার-আপ ট্রফি ওঠে তার শোকেসে।
কিশোর বয়স থেকেই বাংলাদেশ বেতারের ‘সবুজমেলা’সহ বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন তিনি। বেতারে প্রচারিত সচেতনতামূলক নাটকে কণ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন অনেক বছর। জাতিসংঘের আদলে অনুষ্ঠিত ‘ডানমুন ২০১৬’-এর বেস্ট ডেলিগেট হওয়া উর্বী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ আয়োজনে দুই বাংলার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
নিয়মিত লেখালেখি করেছেন জাতীয় দৈনিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাগাজিনে। টিএসসি অডিটোরিয়াম থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চও মাতিয়ে ছিলেন পুতুলনাচের কোরিওগ্রাফি করে, মানব পুতুল সেজে। শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টারের সঙ্গে।
জীবনে কি হতে চেয়ে ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে উর্বী বলেন, বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন কিছু হতে ইচ্ছে করেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দিন থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিলো। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো।
তিনি বলেন, আপাদমস্তক শিক্ষক পরিবারের সন্তান হওয়ার জন্য কিনা ঠিক জানিনা ওই ব্ল্যাকবোর্ড, চক আমায় চুম্বকের মত আকর্ষণ করেছিলো। স্কুল ইউনিফর্ম পরবার বয়স শুরুর বহু আগ থেকে মা বাবাকে দেখেছি সকাল সকাল তৈরি হয়ে ক্লাস নিতে যান। শিশু পার্কে বিকেলে বেড়ানোর স্মৃতি মনে পড়ুক ছাই না পড়ুক মনে পড়ে মা বাবার হাত ধরে তাদের কলেজে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি। স্মৃতির পাতায় আরও খুঁজে পাই প্রিয়তম সঙ্গী পুতুলগুলোকে সামনে বসিয়ে ম্যাডাম ম্যাডাম খেলা। রোলার-কোস্টার জীবনে শৈশব পেরিয়ে সাম্প্রতিক বয়সের স্মৃতি হাতরে পাই ছোট্ট শিশুদের গানের শিক্ষক, হাত খরচের টিউশনি আপা থেকে শুরু করে আমার নিজ কলেজের অতিথি শিক্ষক হওয়ার সৌভাগ্য।
নিজ কলেজ বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে অতিথি শিক্ষক হওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, যে বেঞ্চগুলোতে বসে চুলের ফিতে থেকে শুরু করে পায়ের কেডস পর্যন্ত সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত আমি হাসতে হাসতে ক্লাস করেছি তার ঠিক অপরপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যর বিষয় ছিলো। যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন শ্রদ্ধেয় স্যার-ম্যামরা সেখানে দাড়িয়ে প্রথম যেদিন আমি আমি কথা বলেছি সেদিন থেকেই নিজেকে একটু একটু করে প্রস্তুত করেছি। নিজেকে নিংড়ে যতটুকু আছে দেবার চেষ্টা করেছি আমার জীবনের প্রথম ছাত্রীদের। তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। ডিমান্ড কার্ভ, সাপ্লাই কার্ভ আর স্লোপের উত্থান পতনের মাঝে ভালোবাসার সন্ধান দিতে গিয়ে আমি নিজেই এক ভালোবাসার আকাশের সন্ধান পেয়ে গেছি।
কলেজে প্রথম ক্লাসের অনুভূতি প্রকাশ করে আফরিদা বলেন, যেদিন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস করাতে গিয়েছিলাম সেদিনের অনুভূতিটা অন্যরকম। ছোট্ট থেকে দেখে এসেছি সকালবেলা মা-পাপা একসাথে তৈরি হয়ে কলেজে ক্লাস নিতে যায়। হা করে চেয়ে দেখতাম মা কত চমৎকারভাবে এক নিমিষে শাড়ি পরে ক্লাস নিতে যায়। এই প্রথম আমি আর মা একসাথে রওনা হলাম, মা চলল মায়ের কলেজে ক্লাস নিতে। আমি মায়ের শাড়ি জড়িয়ে আমার শিক্ষা মন্দিরে ক্লাস নিতে। সেই আনন্দের কথা বলে শেষ করা যাবেনা
আরও পড়ুন: বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
একটা বিষয় সবাই বলে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যারা বেশি জড়িত তাদের একাডেমিক ফলাফল ভালো হয়না। তবে উর্বী সেটিকে ভুল প্রমাণ করেছেন। এ বিষয়ে উর্বি বলেন, সাংস্কৃতিক চর্চাটা আমার হৃদয়ের কাছাকাছি একটা ব্যাপার। গান ছাড়া আমার সকাল শুরু হয়না। কখনো আলাদা কোন চাপ হিসেবে ব্যাপারটাকে দেখি নি। তবে পড়াশুনা সবসময়ই আমার প্রথম প্রাধান্য ছিলো৷ আমার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আরেকটু সরব উপস্থিতি হয়তো রাখতে পারতাম পড়াশোনায় সবসময় প্রথম প্রাধান্য দেয়ার জন্য সেই সময়টা একটু কম পেয়েছি।
সফলতার প্রশ্নে আফরিদা বলেন, নিজেকে সফল দাবী করি না আসলে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় যতটুকু অর্জন জীবনে এসেছে মা বাবার প্রচণ্ড সহযোগিতা, উৎসাহ আমাকে এগিয়ে দিয়েছে। আমি প্রচণ্ড রকম সৎ দুজন মানুষের সন্তান। সততা ও পরিশ্রম এই দুটো জিনিসই আমাকে তারা বারবার শিখিয়ে গেছেন।
নতুন কর্মস্থল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পর সবার দোয়া কামনা করে বলেন, আমার হাতেখড়ি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত সকল শিক্ষকের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে এক বিশাল গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিলাম। আমার মা বাবা, ছোট ভাই আদৃত, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, আমার জীবনের বাতিঘর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী, শুভানুধ্যায়ী, হলের রুমমেট, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গীরা, সকলের ভালোবাসায় আমি যেন একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ হতে পারি। আমার বাবা-মায়ের মত একজন আদর্শ ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক যেন হতে পারি সবাই সেই দোয়া করবেন।
স্বপ্ন সফল হওয়ার জন্য অন্যদের পরামর্শ ও নিজের ব্রত প্রসঙ্গে বলেন, পরামর্শ দেয়ার মত যোগ্যতা আছে বলে মনে হয়না, তবে নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে স্বপ্ন সফল হবেই। স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া, পা দুটো মাটিতে, আর হাতে দেশের লাল সবুজ পতাকা, -এই আমার ব্রত।