স্বামীর অনুপ্রেরণায় সহকারী জজ হলেন ইবির রিতু
- আরিফ বিল্লাহ, ইবি
- প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ১১:১৪ AM , আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৫, ১১:৪৫ AM

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে (বিজেএস) তিনবার ব্যর্থ হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থী জান্নাতুল আয়শা রিতু। তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। অবশেষে ১৭তম বিজেএসে পরীক্ষায় সহকারী জজে রিতু ৯৭তম স্থান অধিকার করেন। তার সহকারী জজ হওয়ার খবরে আনন্দ বয়ে যায় তার পরিবার ও আইন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এই পথচলায় তার স্বামী তাকে সাহস যুগিয়েছেন জানিয়ে রিতু বলেন, ‘আমার স্বামী হাফেজ হওয়ায়, সে সব সময় কুরআন থেকে বিভিন্ন আয়াত ব্যাখ্যা করে আমার ঈমান বৃদ্ধিতে সাহায্য করতেন। এ ছাড়া আমার স্বামীও আইনের ছাত্র হওয়ায় দুজন আলোচনা করে আইন পড়তাম।’
১৯৯৭ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার বয়ড়াবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রিতু। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। গ্রামের স্কুলেই রিতুর পড়াশোনার হাতেখড়ি। জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক শেষ করেন গ্রামের স্কুল থেকেই। পরে কলেজে ভর্তির টাকা না থাকায় মায়ের গহনা বিক্রি করে রাজশাহী নিউ গভমেন্ট ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিকেও জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় এই মেধাবী শিক্ষার্থী। এরপর ভর্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে পড়ার সুযোগ পান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে চ্যালেন্জের মুখোমুখি হন তিনি। পরে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের (সিজেডএম) বৃত্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন। পরে বিজেএস পরীক্ষায় তিনবার ব্যর্থ হয় রিতু। এর মাঝে ১৬ তম বিজেএস পরীক্ষার দেওয়ার পর বাবা মারা যান।
রিতুর বিজেএস সফলতার পথচলায় তার স্বামীও এক গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণার নাম। বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হলে তার স্বামী তাকে সাহস যুগিয়েছেন। রিতু বলেন, ‘আমার স্বামী হাফেজ হওয়ায়, সে সব সময় কুরআন থেকে বিভিন্ন আয়াত ব্যাখ্যা করে আমার ঈমান বৃদ্ধিতে সাহায্য করতেন। আমার স্বামীও আইনের ছাত্র হওয়ায় দুজন আলোচনা করে আইন পড়তাম। কঠিন বিষয়গুলো সে খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। সে আইনের নোট করতেন আর আমি জেনারেল বিষয়ের নোট করতাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে আমাকে মানসিকভাবেও বিচারক হিসেবে প্রস্তুত করেছেন।’
বাবার অনুপস্থিতিতে এই প্রাপ্তি অপূর্ণই রয়ে গেল জানিয়ে রিতু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষা সন্দেহাতীতভাবে একটি কঠিন পরীক্ষা। আব্বা-আম্মার পরিশ্রম, সততা ও দূরদর্শিতা আমার বিচারক হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়ায় ঈদে কখনো নতুন জামা না পেলেও বই ও টিউশন ফির টাকা সব সময় আম্মা ব্যবস্থা করে রাখতেন। আম্মা বলতেন প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করে তোমাকে পড়াব তবুও তুমি হাল ছেড়ো না। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জীবনের যত অপ্রাপ্তি ও ব্যর্থতার কষ্ট ছিল তা দূর হয়ে গেছে। তবে এই সফলতায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন আমার বাবা, যিনি এ পৃথিবীতে আর নেই। বাবার শূন্যতায় এই প্রাপ্তি অপূর্ণই রয়ে গেলো।’
রিতুর সহকারী জজ হওয়ার পেছনে সাফল্যের রহস্য সম্পর্কে বলেন, ‘আমি মনে করি বিচারিক পেশায় আশার জন্য শুধু লেখাপড়া করলেই হবে না বরং হতে হবে কৌশলী। আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা রেখে সঠিক দিকনির্দেশনায় থেকে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করতে হবে। সেই সঙ্গে ধৈর্য্য, মানসিক স্থিরতা, সততা, বিনয়, সহনশীলতা ও কথাবার্তায় স্পষ্টতার মতো মৌলিক বিষয়গুলোর চর্চা করতে হবে। একই সঙ্গে আফসোস ও অহংকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শেষ সময়ে এই বিষয়গুলোর ওপর আমি বেশ গুরুত্ব দিয়েছি।’
অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে জুডিসিয়ারির পড়াশোনার ভারসাম্য রক্ষা করা নিয়ে রিতু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘জুডিসিয়ারি পরীক্ষায় ৬০ শতাংশ প্রশ্ন সরাসরি আইন থেকে হয়, সেগুলো আমরা ৪ বছরের অনার্স কোর্সে পড়ে থাকি। তাই একাডেমিক বাড়তি চাপ না নিয়ে আইন বুঝে বুঝে পড়েছি ও কিছুটা নোট করে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করেছি। আমার লেখা এতটাই খারাপ ছিল যে কি লিখেছি তা বোঝাই যেতো না। খাতায় মার্জিন টেনে অ,আ,ক,খ লিখতাম। যাদের লেখা সুন্দর তাদের খাতা এনে সেইভাবে লেখার চেষ্টা করতাম আর নিজে নিজে বলতাম লেখা সুন্দর করতে পারলে জজও হইতে পারব। প্রতিটি আইনের প্রিলি ও রিটেনে জন্য আলাদা আলাদা নোট করে পড়েছি। প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি বুঝে বুঝে পড়েছি এবং বারবার রিভিশন করেছি। বুঝে পড়ার পাশাপাশি মুখস্থ করার ওপরও বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। পড়ার সময় অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দিতাম না। ফোন বালিশের নিচে রেখে দিতাম। ঘণ্টা ধরে কখনো পড়িনি। তবে রুটিন করে প্রতিদিনের টার্গেট পড়া নিতাম এবং যত সময়ই লাগুক তা শেষ করতাম। এতে গড়ে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা পড়া হতো।’
বিচারক হতে চাওয়া জুনিয়রদের উদ্দেশ্যে রিতু বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে কারণ লিখিত পরীক্ষার নম্বারের ওপরেই চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করে। অনেকেই মনে করেন বাংলা, ইংরেজি ও বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক বিষয়ে তেমন প্রস্ততি না নিয়ে পরীক্ষার হলে বানিয়েই লেখা যাবে। এটা একদমই ভুল ধারণা। বরং আগে থেকেই রচনা, ভাবসম্প্রসারণ ও ব্যাকরণের মত বিষয়গুলো বারবার প্র্যাকটিস করতে হবে। আর বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক বিষয়ের জন্য এলোমেলো অনেক বই না পড়ে বিসিএস এর কোনো লিখিত বই থেকে বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত পড়তে হবে এবং বিশ্বের চলমান ঘটনার প্রতি নজর রাখতে হবে। অনেকেই আমার মতো ইংরেজিতে খুব দূর্বল তাদের বলব বিসিএস ও বিজেএস এর লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বারবার প্যাকটিস করতে। জুডিসিয়ারির প্রশ্নগুলো বারবার বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ টপিক গুলোর ওপর বেশি জোর দিতে হবে।’