ক্যাডার হয়ে একরামুল বললেন— স্ট্রাগল আছে বলেই জীবন সুন্দর
- সুজন চন্দ্র দাস, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:২৪ PM , আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:২৫ PM
মো. একরামুল হক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। সর্বশেষ প্রকাশিত ৪৩তম বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। তার এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প।
একরামুলের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে। বাবা মো. ইউনুস উদ্দীনের বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে চাকরির সুবাদে তার বেড়ে ওঠা টাঙ্গাইলে। ২০১০ সালে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং ২০১২ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন একরামুল।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা মারা যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই তাকে পুরো পরিবারের হাল ধরতে হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি একদিকে নিজের খরচ অন্যদিকে চার ভাই-বোন ও মাকে নিয়ে পরিবারের খরচ চালানো ছিল তার জন্য খুবই কষ্টের ও সংগ্রামের। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ে গড়ে ৮-৯টি টিউশন করেছেন একরামুল।
শেষবর্ষে এসে উপলব্ধি করেন টিউশনের পেছনে বেশি সময় দেওয়ার কারণে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার গঠনের জন্য স্কিল প্রয়োজন তা গড়ে ওঠেনি তার। দীর্ঘ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এবং টিউশন কেন্দ্রিক লাইফস্টাইলের ফলে নিজ বিষয়ভিত্তিক চাকরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে করোনাকালীন সময়ে তার ভাই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকুরিচ্যুত হলে তিনি অনুভব করেন, সরকারি চাকরিই ক্যারিয়ারের জন্য বেশ নিরাপদ।
ভাই চাকরিচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে করোনার কারণে টিউশনগুলোও চলে যায় একরামুলের। সেসময়ে জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনগুলো দেখেছেন একরামুল। তখনই প্রাইভেট চাকরির প্রতি আস্থা হারান তিনি। মাথায় আসে বিসিএসের সরকারি চাকরির ভাবনা। সেই ভাবনা থেকেই ৪১তম বিসিএসে আবেদন করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন।
আরও পড়ুন: ‘ভাঙা হাতে’ লিখে বিসিএস জয় মাভাবিপ্রবির নাহিদের
বিসিএস যাত্রায় নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে একরামুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, চতুর্থ বর্ষে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই চাকরির জন্য পড়াশোনা শুরু করি। প্রস্তুতির শুরুতে আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইএসআরএম বিভাগের বড় ভাই ও বর্তমানে দুদকের সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম। তিনিই আমার বিসিএস যাত্রার গুরু।
তিনি বলেন, শুরুটা তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই করা। এরপর লাইভ এমসিকিউ বুস্টার নামক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে যাই। একটা কমিউনিটি গড়ে ওঠে এবং তাদের সাথেই প্রস্তুতি নিতে থাকি।
৪১তম বিসিএস ছিল আমার প্রথম বিসিএস। তখন করোনার প্রকোপে সবকিছু বন্ধ। আমি বন্ধের সময়টাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছি। প্রচুর টিউশনি করার কারণে প্রিলিমিনারি আমার জন্য সহজ হয়ে যায়। প্রস্তুতির মাত্র ৬ মাসের ভেতর আমার সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি হয়ে যায়।
তিনি জানান, সারাদিন ব্যাংকে শ্রম দিয়ে বাসায় ফিরে পড়ার মতো অবস্থা থাকতো না তার। তাই ৪১তম বিসিএসে ক্যাডার পাওয়া হয়নি। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেকচারার পদে নন-ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হন তিনি।
প্রথম শ্রেণির একাধিক চাকরি পেলেও একরামুল প্রতিজ্ঞা করেছিলেন চাকরি করে হাজার কষ্ট হলেও ক্যাডার তিনি হবেন। তিনি বলেন, ব্যাংক পাড়ায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ব্যাংকে ঢুকে পড়ালেখা করে অন্য চাকরি পাওয়া নাকি প্রায় অসম্ভব। ব্যাংকে চাকরি করা অবস্থাতেই আমি ৪৩তম ও ৪৪তম প্রিলি উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষা দেই এবং ৪৫তম প্রিলি উত্তীর্ণ হই।
তিনি আরও বলেন, সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অফিস করে এসে রাত ১-২টা পর্যন্ত পড়তাম। ভোর ৬টায় উঠে সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পড়ে অফিসে যেতাম। সকালে অন্তত ১ ঘণ্টা পত্রিকা প্রতিনিয়ত পড়তাম।
এই সাফল্যের পেছনে তার স্ত্রীর অনুপ্রেরণাও কম ছিল না বলে জানান তিনি। একরামুল জানান, আমার স্ত্রী আমাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ৪৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সময় ২১ ঘণ্টা পরীক্ষার ২১ ঘণ্টায় সে জায়নামাজে ছিল।
আরও পড়ুন: টানা তিনবার প্রিলি ফেল, চতুর্থ বিসিএসে বাজিমাত আরিফুলের
নিজের সকল কৃতিত্বের পেছনে মূল কারিগর তার ভাই বলে জানান একরামুল। তিন বলেন, আমার জীবনে কোনো কিছুই সহজে পাইনি। কষ্ট করে পরিশ্রম করে অর্জন করেছি। বাবা মারা যাবার পর আমার যাবতীয় পড়াশুনার দায়িত্ব নেন আমার বড় ভাই। আমার বড় ভাই না থাকলে আমি এত দূর কখনোই আসতে পারতাম না।
নিজের কষ্ট, ধৈর্য আর প্রচেষ্টার দিনগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে ৮-৯টি করে টিউশন পড়িয়ে পরিবার সামলেছি। চাকরি করে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে বিশ্রাম না করে টেবিলে পড়তে বসে গিয়েছি। অনেক কষ্ট হয়েছে, কিন্তু থেমে যায়নি। আমার কাছে মনে হয় এটাই জীবনের সৌন্দর্য। স্ট্রাগল আছে বলেই জীবন সুন্দর।
বাবার দেওয়া শিক্ষার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একরামুল বলেন, মৃত্যুশয্যায় বাবা আমার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় যার আছে ভূরিভূরি রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ এটাই ছিল আমার বাবার সাথে শেষ কথা। আমি সেই আদর্শ নিয়েই জীবন গড়ছি।
সততা এবং নিষ্ঠার সাথে বাবার আদর্শকে ধারণ করে প্রজাতন্ত্রের সেবা করার প্রত্যয় একরামুলের। অডিট এন্ড একাউন্টস ক্যাডার প্রজাতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হওয়ায় সরকারি দফতরে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেতে চান মাভাবিপ্রবির এই শিক্ষার্থী।
একরামুল নতুনদের উদ্দেশ্যে বলেন, নিয়ত পরিষ্কার থাকতে হবে। সে অনুযায়ী পরিশ্রম করতে হবে। নিজেকে নিয়ে আশাবাদী হতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে, "Hope is a good thing, maybe the best of things, and no good thing ever dies."