‘ভাঙা হাতে’ লিখে বিসিএস জয় মাভাবিপ্রবির নাহিদের
- সুজন চন্দ্র দাস, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:১২ PM , আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:১০ PM
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের সাবেক শিক্ষার্থী মো. আওসাফুল ইসলাম নাহিদ। সর্বশেষ প্রকাশিত ৪৩তম বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) সহকারী কর কমিশনার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। নাহিদ ৪০, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসে অংশ নিয়েছেন। তৃতীয়বারে এসে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। তার এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প।
নাহিদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়। তার বাবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। আর মা গৃহিণী। নাহিদের দুই ভাই ও তিন বোন।
২০১৭ সালের শেষ দিকে যখন নাহিদের স্নাতক শেষ হতে মাত্র এক সেমিস্টার বাকি, তখন একটি দুর্ঘটনায় তার ডান হাতের মধ্যমা আঙুল ভেঙে যায়। এরপর তার ডান হাত দিয়ে লেখা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। উপায় না দেখে বাম হাত দিয়ে লেখার চেষ্টাও করতে থাকেন তিনি। এক পর্যায়ে ডান হাত দিয়ে লিখতে পারলেও সেটা চালিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল তার জন্য। লেখা শুরুর একটু পরপর নিতে হতো বিরতি।
আঙুলের এমন পরিস্থিতি নিয়ে তার জন্য বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় বসা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। সে জায়গা থেকে তিনি তার উদ্যম প্রচেষ্টা ও ধৈর্যের ফলে পেয়েছেন সাফল্যও।
এ বিষয়ে মো. আওসাফুল ইসলাম নাহিদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দুর্ঘটনার পর আমি ডান হাত দিয়ে আর কখনও লিখতে পারব কিনা সেটাই অনিশ্চিত ছিল। তাই আমি বাম হাতে লেখার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে হচ্ছিলো না। পরে আবার ডান হাতেই লেখা শুরু করি।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের আগস্টে আমাদের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফলাফল প্রকাশিত হয়। ওই সময় আমার এই ভাঙা হাত দিয়ে বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ঢাবিতে এমবিএর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঢাবির এমবিএর জন্য চূড়ান্ত সাক্ষাৎকারে বাদ পড়ি। সেবার ৯৩ জনের মধ্যে ৬০ জন নেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: টানা তিনবার প্রিলি ফেল, চতুর্থ বিসিএসে বাজিমাত আরিফুলের
বিসিএস নিয়ে নিজের অনুপ্রেরণার কথা জানতে চাইলে আওসাফুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি ঢাবির সমাজকল্যাণ অনুষদের অধীনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস এন্ড লেবার স্টাডিজে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হই। পড়াশোনা অবস্থাতে প্রস্তুতি ছাড়া ৪০তম বিসিএসের প্রিলিতে অংশগ্রহণ করি। আল্লাহর রহমতে প্রথম বিসিএসেই উত্তীর্ণ হই।
তিনি বলেন, এরপর অনেকটা বাজি খেলার মতো ঝুঁকি নিয়েই আমি স্নাতকোত্তর মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে বিসিএসের জন্য পড়ালেখা শুরু করি। ভালোভাবে পড়াশোনা করার জন্য বাসাও ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের সাথে মেসে থাকা শুরু করি। তবে এ বিসিএসে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাননি তিনি।
এরপর ৪১তম বিসিএসের জন্য নাহিদ দ্বিগুণ গতি নিয়ে শুরু করেন প্রস্তুতি। ৪১তম প্রিলির জন্য তিনি যখন শতভাগ প্রস্তুত তখনি বিশ্বব্যাপী দেখা দেয় করোনা মহামারি। সেই সময়ে ভাঙা হাতে লেখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে কাজ করেন তিনি।
নাহিদ বলেন, অনুশীলনের সময় ভাঙা হাড়ের কারণে কিছুক্ষণ লেখার পরপরই আমাকে বিরতি নিতে হতো। তা না হলে হাতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ৪১তম প্রিলি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমার আসল যুদ্ধ শুরু হয়। রিটেনের সেই বিশাল সিলেবাসের পড়ালেখার পাশাপাশি আমাকে করতে হয়েছে হাতের লেখার প্র্যাকটিস।
তিনি বলেন, লিখিত পরীক্ষায় সবাই যখন টানা লিখতে থাকে তখন আমি হাতের ব্যথার কারণে প্রতি ১০-১৫ মিনিট পরপর লেখা থামিয়ে বসে থেকেছি। ভাঙা হাত নিয়ে পরীক্ষার মাঝেই কয়েকবার কান্নাও করেছি।
ভাঙা হাত নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার করুণ অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে নাহিদ আরও বলেন, ৪১তম বিসিএসে কোনো প্রশ্নের উত্তর ডিমান্ড অনুসারে লিখতে গেলে সময় পেতাম না। আবার ঠিক সময়ে লিখতে গেলে প্রশ্ন উত্তর অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তাই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও আমি ক্যাডার পাইনি। নন-ক্যাডার থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ১০ম গ্রেডের পরিদর্শক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।
ভাঙা হাত নিয়ে বিসিএস জয়ের দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প রয়েছে নাহিদের। তিনি বলেন, যেখানে বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় প্রতিটা সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে আমাকে প্রতি ১০-১৫ মিনিট পরপর ৩০ সেকেন্ড করে বিরতি নিতে হয়। যে সময়ে অন্যরা লিখে ২ পেজ সে সময়ে আমি লিখতে পারতাম ১ পেজ। তাই ৪৩তম বিসিএসে আমি আমার উত্তরগুলাকে গোছানো, সংক্ষিপ্ত ও তথ্যবহুল করার চেষ্টা করেছি। যাতে করে কম লিখেও ভালো নম্বর পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে ৮ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষায় ২৫-৩০ শতাংশ উত্তর দিতে পেরেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় ৪৩তম বিসিএসের ফলাফলে বিসিএস (কর) ক্যাডারে ২৬তম হয়েছি।
নাহিদ জানান, তার বিসিএসের অনুপ্রেরণা ৩৭তম বিসিএসের সহকারী পুলিশ সুপার জনাব সাইফুর রহমান। যার একান্ত প্রচেষ্টা ও দিকনির্দেশনায় তার বিসিএসের হাতেখড়ি। তিনি বলেন, এই পথচলায় আমার নিজের বড় ভাইয়ের মতো সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে সর্বক্ষণ পাশে ছিলেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের বড় ভাই মো. শরিফুল ইসলাম রাকেশ এবং আমার সহপাঠী ফরিদ হাসান ও বাল্যবন্ধু মোরসালিন শিকদার সজল। যাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ ও ঋণী।
তিনি বলেন, আমি কোনো কোচিংয়ে ক্লাস করিনি, তবে বিভিন্ন কোচিংয়ে প্রিলি ও লিখিত মডেল টেস্ট দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও চাঁদপুর, মাভাবিপ্রবির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাভাবিপ্রবি ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের মাভাবিপ্রবি শাখার প্রথম কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলাম। ক্যাম্পাস লাইফে ক্লাব বা সংগঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ক্যারিয়ারে বা চাকরির ভাইভাতে কাজে আসে।
বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, অনুজদেরকে একটা স্বপ্নের কথা বলতে চাই। বিসিএস পরীক্ষা হচ্ছে এমন একটি দরজা, যেটা এমন এক অদৃশ্য ও স্বর্গীয় কমিউনিটিতে প্রবেশ করাবে যে কমিউনিটির ধরণ-গড়ন ও আনন্দ সেখানে প্রবেশ না করে অনুভব করার কোনো সুযোগ নেই।