একজন হার-না-মানা ‘ফ্রিল্যান্সার’ শোভনের সফলতার গল্প

শোভন
শোভন   © টিডিসি ফটো

‘সবুরে মেওয়া ফলে’- প্রবাদটি অন্য কারো কাছে সত্য হোক বা না হোক কিন্তু তা ফ্রিল্যান্সার শোভনের ক্ষেত্রে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কেননা বারবার ধাক্কা খেয়ে পুনরায় লেগে থাকা, পরিবারের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, কাজের চাপে কাঙ্ক্ষিত পড়াশোনা করতে না পেরে শুধুমাত্র ফ্রিল্যান্সিং-কে পেশা এবং নেশা হিসেবে গ্রহণ করে সফল হওয়া এক স্বপ্নবাজ আবু সাঈদ বিন শোভন। আজ দেশে যিনি একজন পেশাদার ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পরিচিতি। তবে এই সফলতার সহজ ছিল না। বরং ছিল বাধা ও চ্যালেঞ্জে ভরপুর। 

দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শিক্ষকের কাছ থেকে প্রথম ফ্রিল্যান্সিং শব্দটির সাথে পরিচিত হোন কুমিল্লার ছেলে শোভন। জানতে পারেন, ফ্রিল্যান্সিং করে ঘরে বসে বিদেশি মার্কিন ডলার আয় করা যায়। সেই থেকে শুরু। দিনরাত ডলার আয়ের স্বপ্ন মাথায় নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করার নেশায় এদিক-সেদিক ছুটোছুটি। যেভাবেই হোক তাকে ডলার আয় করতেই হবে। যথারীতি বাড়িতে জানালেন তার একটি কম্পিউটার দরকার। কারণ তিনি ঘরে বসে কাজ করে ডলার আয় করবেন। কিন্তু তার এই আবদার পূরণ করাতো পরিবারের কাছে অমাবস্যার চাঁদের মতো। কেননা যেখানে দুবেলা খাবার জোগাড় করতে পরিবারকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেখানে ৩০-৪০ হাজার টাকা দিয়ে তাকে কম্পিউটার কিনে দেয় এমন সাধ্য কি পরিবারের আছে! 

তবুও হাল ছাড়েননি তখনকার স্বপ্নবাজ কিশোর শোভন। ছোট থেকেই জেদি শোভনের বহু আবদারের পর এক সময় ঘরে আসে সেই বহু কাঙ্খিত কম্পিউটার।

বলে রাখা ভালো, শোভন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারে বাবা ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। শোভন জন্মের পর থেকেই অভাব অনটনে দিনাতিপাত করতে থাকে তাদের পরিবার। ছোট্ট একটি দোকানের উপর দিয়ে কোনরকম দিন পার করছিল শোভনের পিতা-মাতা ও পরিবার। 

আরও পড়ুন: এক মোটরসাইকেলে প্রাণ গেলো তিন কলেজ ছাত্রের 

পরিবারের এই সংগ্রামের মধ্যেই শোভন বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। তাই তার বাবা বিদেশে পাঠানোর কথা বলতেন। এটি তার কাছে অনুপ্রেরণা ছিল। এমনকি স্থপতি (আর্কিটেক্ট) হওয়ার ইচ্ছেও ছিল শোভনের। কিন্তু গ্রামের স্কুল শিক্ষকের ভুল পরামর্শে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় তার। তবে সেটা ব্যর্থ হলেও ফ্রিল্যান্সার হওয়ার স্বপ্ন ঠিকই পূরণ করেছেন এই যুবক। টানা ৯ বছর বিভিন্ন জায়গায় ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে শিখেছেন। কাজ করেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, মানুষের কথা শুনেছেন। অনেক সময় হতাশ হয়েছেন কিন্তু দিনশেষে আবার কাজ করেছেন। ফলে আজ দেশের প্রথম সারির  ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।  পরিবারের অভাব দূর করে স্বাচ্ছন্দ্যের হাওয়া এনেছেন।  

এ উদীয়মান ফ্রিলান্সার এখন নিজে ফ্রিল্যান্সিং করার পাশাপাশি আগ্রহী তরুণদের প্রশিক্ষণও দেন, কৌশল শেখান। দেশ জুড়ে বর্তমানে তাঁর প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। তিনি অ্যামাজনে টি-শার্ট বিক্রির পাশাপাশি কেডিপি প্যাসিভ আর্নিং-এ কাজ করে থাকেন। বর্তমান তার মাসিক আয় প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার মার্কিন ডলার। এছাড়া তার সাথে কাজ করা নবীন শিক্ষার্থীরাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশি ডলার আয় করছেন৷ জানা গেছে, গত বছরের তিনমাসে (অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর) প্রায় ২৫ হাজার ডলার আয় করেছেন তারা। ফ্রিল্যান্সিং- এর মৌলিক বিষয়ে জানার পাশাপাশি বিশ্বস্ততার সাথে তার সাথে কাজ করা ও উপার্জন করতে পারছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

ফ্রিলান্সিং জীবনে তিক্ততম সময়ের কথা জানিয়ে আবু সাইদ বিন শোভন বলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে সবচেয়ে বড় বোকামি ছিল বারবার মার্কেট প্লেস পরিবর্তন করা। যার ফলে জীবনে অনেক সময় ও শ্রম নষ্ট হয়েছে। তাই এই পথে সফল হতে হলে যা করতে আগ্রহী সেটা নিয়েই কাজ করতে হবে। কেননা ছুটোছুটি করে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হওয়া যায় না। সফল হতে নিয়মিত ও সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে হবে। এ জন্য ধৈর্য হলো সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এটাকে জয় করতে পারলে সফলতা নিশ্চিত। 

শোভনের মতে, ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং করা যায়- এটা সবচেয়ে  ফালতু কথা। কারণ এতে কিছু টাকা আয় হবে কিন্তু বড় কোন ব্যবসা দাঁড় করানো বা বড় আয় সম্ভব হবে না। সেজন্য এতে ভালো কিছু করতে হলে কয়েকজন মিলে অফিসিয়ালি বা সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হবে। আর এই কাজ করতে তিনটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে- ১. যেকোন একটি কাজ ভালো করে শেখা, ২. মার্কেট প্লেসে প্রবেশের আগে নিজের ভালো মানের একটি পোর্টফোলিও তৈরি করা এবং তারপর মার্কেট প্লেসে প্রবেশ করে নিবিড় অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা। তাহলেই কেবল একটি ব্যবসা দাঁড় করানো সম্ভব হবে। 

দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে নিজের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই উদীয়মান ফ্রিল্যান্সার। বর্তমানে নিজেদের ব্যক্তিগত টিম নিয়ে কাজ করে থাকেন এবং শোভন গ্রাফিক্স নামে একটি ফ্রিল্যান্সিং কোম্পানি পরিচালনা করেন। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং জোন নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে সবাইকে ফ্রিতে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে থাকেন।

নবীনদের সফলতার বিষয়ে এ ফ্রিল্যান্সার বলেন, উপার্জন করা অর্থ শুরুতেই ইচ্ছে মতো উড়িয়ে দেয়া উচিত নয়। উপার্জনকৃত অর্থের ৬০ ভাগ খরচ করে ৪০ শতাংশ জমা করতে হবে। কারণ এই জমাকৃত অর্থ দিয়ে মার্কেট প্লেসকে প্রসারিত করাতে হবে। ফেসবুক ও অ্যামাজনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজকে প্রসারিত করতে হবে। এমনকি নিজের ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট ও কর্মক্ষেত্রে একটা ভালো পরিমাণ অর্থ ইনভেস্ট করতে হবে। তবেই সফলতা আসতে শুরু করবে। 

উপার্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “ফ্রিল্যান্সিংয়ে ঢুকেই হাজার হাজার ডলার আয় হয়। এমন স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে হবে। কারণ ব্যবসায় ঢুকে কখনই কেউ একবারে বিরাট কিছু করতে পারে না। এটাও ঠিক একই রকম। তাই সময় নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে আস্তে আস্তে আয় বাড়বে। কেননা একটা কথা মাথায় রাখতে হবে- ফ্রিলান্সিং করে কেউ রাতারাতি বড়লোক হয় না।”

এ পথে টিকে থাকার বিষয় তুলে ধরে শোভন বলেন, “একটু উপার্জন করা শিখলেই অনেকে প্রেম কিংবা মেয়ে বিষয়ক কাজে জড়িয়ে যায়। ফলে অনেক উদীয়মান ফ্রিল্যান্সার অকালে ঝরে যায়। অথচ তারা আর একটু সময় দিলে ভালো কিছু করতে পারতো। তাছাড়া  অনেক হারাম বা অসৎ কাজ করে ইনকামের সুযোগ আছে। তবে সেটা দিয়ে সফলতার পেলেও শান্তিতে জীবন কাটাতে খুব কমজনই পারে। তাই হালাল উপার্জন জরুরি যেটা আপনাকে সফল করবে।” 

উপার্জনের পাশাপাশি ইবাদাতের বিষয়কেও গুরুত্ব দেয়ার আহবান জানিয়ে শোভন বলেন, ”এ পথে অনেক উপার্জন করা সম্ভব। তবে এই উপার্জন করতে গিয়ে নিজের রবকে ভুলে গেলে হবে না। কারণ আল্লাহ দুই ধরণের রিজিক দেয়। প্রথমত, তিনি এমন রিজিক দেন যে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে মৃত্যু চলে আসে। ফলে তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার আর কোন সুযোগ থাকে না৷ অন্য দিকে হালাল রিজিক আল্লাহ নিজ হাতে দেন যা বান্দাহকে সন্তুষ্ট রাখে। তাই হালাল উপার্জন অতি জরুরি।”


সর্বশেষ সংবাদ