রাস্তায় ঘুমানো, নুন-ভাত দিয়ে জীবন কাটানো ঢাবির নাহিদ হার মানেননি

নাহিদ হাসান
নাহিদ হাসান  © সংগৃহীত

জীবন হলো উত্থান-পতন, সংগ্রাম ও বিজয়ে ভরা একটি যাত্রা। মা-বাবা ছাড়া বেড়ে ওঠা নাহিদ হাসান কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২য় বর্ষে অধ্যায়নরত। খেয়ে না খেয়ে থাকা, রাস্তায় ঘুমানো, বস্তিতে ঘুমানো, আত্মীয় স্বজনের মারধর কি ছিলনা তার জীবনে। সব বাধা উপেক্ষা করে জীবনে ঘুরে দাড়িয়েছেন নাহিদ হাসান। তার সংগ্রামী জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরেছেণ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মুহাইমিনুল ইসলাম-

নাহিদ হাসান বলেন, সংগ্রাম শব্দটি খুব চেনা! কারণ জন্ম লগ্ন থেকেই সংগ্রাম করে আসছি। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম, আখিরাতে সফল হওয়ার সংগ্রাম। তাই সংগ্রাম শব্দটি বিবেচনায় নিলে আমার পুরো জীবনই লেখা হয়ে যাবে! পরিবার বলতে আমার কখনো কিছু ছিলই না! জন্মের পর বছরখানেকের মাথায় মাকে হারিয়েছি (ক্যান্সার হয়েছিল) এরপর বিক্ষিপ্তভাবে বড় হওয়ার যাত্রায় যখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন বাবাকে হারিয়েছি; তবে বাবার সঙ্গ পাওয়া, ভালোবাসা পাওয়া এর কোনটাই আমার কপালে জোটেনি। কারণ মার মৃত্যুর সাথে সাথে বাবার প্যারালাইসিস হয়ে যায়। ওনার হাঁটতে এবং কথা বলতে খুব কষ্ট হতো।

আমার বেড়ে ওঠা: জন্মের পর বড় বোনের কাছে কয়েক বছর ছিলাম, বোনের বিয়ের পর মামার বাসা, অতঃপর খালার বাসা, জ্যাঠার বাসা, এতিমখানা, দত্তক সন্তান হিসেবে, তারপর আবার দীর্ঘ একটা সময় মামার বাসা, স্কুলে, কলেজে, মসজিদের বারান্দা, এমনকি রাস্তাতেও আমাকে রাত কাটাতে হয়েছে। এই বিভীষিকাময় সময় গুলো অনেক দীর্ঘ ছিল, শুধু জানতাম আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে; আলহামদুলিল্লাহ! জীবনের কঠিন সময়গুলোতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আল্লাহর সাহায্য পেয়েছি। কখনো বা তিনি আমার মনোবল শক্ত করে দিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে সাহায্য করেছে আবার কখনো বা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার সময়গুলোতে আমার পরওয়ারদেগার আমার জন্য পথ খুলে দিয়েছে।

আমার জন্মের পূর্বে আমার পরিবারিক অবস্থা:

লোকমুখে বাবার অনেক প্রশংসা শুনেছি; শুনেছি ওনার উত্থান এবং পতনের গল্প! তবে এক কথায় বাবার কথা বলতে গেলে তিনি নিতান্তই ভালো মানুষ ছিলেন।আমাদের গ্রামের বাসা ঝিনাইগাতী, শেরপুর, ময়মনসিংহ। সেখানে বাবা দশ বছর চেয়ারম্যান ছিল। প্রারম্ভে ছিল স্কুল শিক্ষক, একাধিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি! লোকজনের জোরাজুরিতে চেয়ারম্যান দাঁড় এবং অর্থকরী খরচ করা ছাড়াই সফলভাবে নির্বাচিত হন। আজ এত বছর পরেও গ্রামে গেলে বাবার স্মৃতিচারণে মানুষের চোখে পানি দেখতে পাই। তখন আমাদের ছিল একাধিক বাড়ি। কিন্তু আমার জন্মের সাথে সাথে মার ক্যান্সারজনিত কারণে মৃত্যু, আব্বুর প্যারালাইসিস, বোনের বিয়ে আর অন্যদিকে দাদা (আমার বড় ভাই) বাবার সাথে ঝগড়া করে গাজীপুর চলে আসেন। 

উল্লেখ্য আমার বোন আমার থেকে প্রায় ১৬-১৭ বছরের বড়, আর দাদা ২১ বছরের বড়। একদিকে বাবা অসুস্থ মুহূর্তে একা হয়ে যান অন্যদিকে আমাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর যেটুকু জমি বাড়ির সম্পত্তি ছিল বাবার ভাষ্য মতে তিনি তা বিক্রি করে দিয়ে নিজের চিকিৎসা করেন। আমি আমাদের জমি জমার ছিটে ফুটাও দেখিনি, বাবাকে দেখেছি কিছু বছর ঝিনাইগাতী বাজারে একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে থাকতে; তখন সম্পর্ক বুঝতাম না, বুঝতাম না বাবা কি! তারপর অনেক বছর বাবার হুদিস পাইনি। বড় হবার পর জেনেছি বাবা তখন জেঠার বাসায় থাকতো। ওনার অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল ছিল, বিছানা থেকে বেশি একটা উঠতে পারত না।

এতিমখানার জীবন 

আপুর বিয়ের পর কিছুদিন মামার বাসায় থাকা হয়; তারপর বাবা আমাকে এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে বছরখানেক ছিলাম। আর এই সময়টাতে আমি যখন নামাজ পড়ার জন্য অজুখানায় গিয়ে অজু করতাম আজিজ নামে এক লোক আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। উনার কোন পুত্র সন্তান ছিল না; ছিল দুই মেয়ে; অনমিকা আর কণিকা। আমাকে দেখে ওনার ভালোলাগার পর এতিমখানার কর্তৃপক্ষ আর বাবার সাথে কথা বলে আমাকে দত্তক সন্তান হিসেবে তারা এডাপ্ট করেন। সে বাড়িতে এক বছর ছিলাম; জীবন মোটামুটি ভালোই চলছিল কিন্তু একটা ভুল বুঝাবুঝিতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হয়। আমার নতুন ঠিকানা হয় মামার বাড়ি।

মামার বাসায় আমার জীবন: 

সেখানে আমার জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল আমি জানতাম না আমি কে, কি আমার পরিচয়, কে আমার বাবা, এটাও জানতাম না যে আমার ভাই বোন আছে, কারণ জন্মের পর বোনকে দিদা নামে চিনেছি, বোনের বিয়ের পর, না আমার বোন আমার খোঁজ নিয়েছে না আমার ভাই। ফলে শুধু এটুকু জানতাম দিদা নামে আমার একজন আপন মানুষ ছিল কিন্তু সে আমাকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও চলে গেছে। আর মার কথা জিজ্ঞেস করলে সবাই আকাশের চাঁদ কে দেখিয়ে দিয়ে অনেক কিছুই বলতো। মার চেহারা মনে নেই; বলা যায় মাকে কখনো দেখিনি। মামা-মামির পরিবার বলতে আমি, মামা, মামি, দুই মামাতো ভাই, দুই ভাবি। কিন্তু আমাকে সব সময় পরিবারের বাইরে রাখত। আমার উপর চলত শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আমার মামি। মামীর চেয়ে নিষ্ঠুর, জাহেল মানুষ আমি আমার জীবন দশায় দুজন দেখিনি! সে বাসায় একমাত্র আদর করতো মামা, আর সোহেল ভাই (মামাতো ভাই) কিন্তু ওনারা বাসায় থাকত না।

এই সুযোগে আমার মামি আমাকে দিয়ে রান্না করাতো, ঘর দুয়ার পরিষ্কার করানো, তিন চারটা গরু দেখা, হাঁস-মুরগি, জমির ক্ষেত পরিচর্যা করা, ধান কাটা, বাজার করা। কাজ! কাজ! আর কাজ!; সেই বাড়িতে সাত বছর ছিলাম, আমাকে যখন যা বলা হয়েছে কোনোদিন বলিনি আমি এটা এখন করতে পারব না পরে করব! মামা ছিল অনেক দুর্বল মানুষ! মামাকে বললে পরদিন মামি আমার উপর অনেক টর্চার চালাত। বিনা কারণে খুব মারতো। ক্রিকেট খেলার ব্যাট, র‍্যাকেট খেলার ব্যাট, কারাল, গরম ভাজাকাটি এসব ছিল মারবার অস্ত্র। 

আমাকে একটু খেলার সময় দেওয়া হতো না, মিশতে দেয়া হতো না বন্ধুদের সাথে, যেতে দেয়া হতো না স্কুলে। ক্লাস এইট পর্যন্ত শক্তভাবে আমার স্কুলের কোন লেখাপড়া নেই।

অথচ রাতেও রেহাই নেই, মামী আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ে রাতে বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরতো। তিনি গ্রামের মানুষ অন্যদিকে আমার আরেক মামাতো ভাই শাকিল নেশায় আসক্ত, মামী বিশ্বাস করত শাকিল ভাইকে ওষুধ করেছে তাই তিনি মাজারে মাজারে ঘুরত। সারাদিন কাজের পর, রাতে এভাবে জেগে থেকে আবার পরদিন সবার আগে ভোরে আমাকেই উঠতে হতো; দেরি হলেই কপালে জুটত মামির মার আর অসভ্য ভাষায় গালাগালি।এমনকি মামির সম্মতিতে শাকিল ভাইয়ের আন্ডারে আমাকে দিয়ে হিরোইন সাপ্লাই এর কাজও করানো হয়েছে।

সেই বাসায় আমি বড্ড অসহায় ছিলাম, এখনো মনে পড়ে আমার সম-বয়সীরা দোকানে গিয়ে বাহারি রকমের মজা খেতো আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম কারণ ৫ টা টাকা চাওয়ার মত দুনিয়ায় আমার কোন মানুষ ছিল না। এমনকি ইদ উপলক্ষ্যে যা ৫০-৬০ টাকা পেতাম মামী তা নিয়ে নিতো। বলতো তার কাছে নিরাপদ! মামিকে মিথ্যা বলার সাহস আমার কখনো হয়ে ওঠেনি কারণ উনি আমাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিল যে তিনি সব জানেন, যা কিছু আমি গোপন করি আর যা কিছু আমি প্রকাশ করি।তবে এত টর্চারের পরেও একটা জিনিস মিলত; তিন বেলা পেট ভরে খাবার মিলত; কিন্তু আমাকে কখনো একটা আস্ত মাছ দেওয়া হয়নি, বঞ্চিত হতাম অনেক খাবার থেকে তখন ছোট ছিলাম তাই খুব খারাপ লাগতো। এখন বুঝি!

এক প্রতিবেশীর সহায়তায় বাবার সন্ধান পাই, পাশাপাশি আমার ভাই বোনের নাম্বার ম্যানেজ করতে সক্ষম হই। তারা তখন গাজীপুর থাকতো। ফোন করে আমি তাদেরকে আমার বাবার অসহায়দের কথা বলি। তখন বাবা জ্যাঠার বাসায় থাকতো, বিছানা থেকে উঠতে পারত না। সব মিলিয়ে দাদা আর দিদা বাবাকে গাজীপুর নিয়ে আসর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাবাকে দেখবে কে? দাদা, ভাবি, দিদা, দুলাভাই সবাইতো চাকরি করে! এই ফাঁকে কপাল খুলে আমার। বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে গাজীপুর নিয়ে আসা হয়। মামা মামির বাসা থেকে যেতে দিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু আশেপাশের গ্রামের মানুষের সহায়তায় সেখান থেকে আমার মুক্তি মেলে। আলহামদুলিল্লাহ! জীবন এত সুন্দর! আমার গ্রামের বাইরের দুনিয়া এত বড়! আমি এখন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারবো!

গাজীপুরে নতুন জীবন 

গাজীপুরে আমাকে একটি স্কুলে (ছায়াবিথী সোসাইটি উচ্চ বিদ্যালয়) সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তখন স্কুলে যেতে পারতাম না কারণ বাবাকে খাওয়ানো-পরানো, পয়-পরিষ্কার করানোর দায়িত্ব আমার উপর ছিল। দুনিয়াদারি সম্পর্কে তখনও অতটা বুঝতাম না; কারণ মামি যে আমার দুনিয়া একেবারে সংকীর্ণ করে দিয়েছে, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারতাম না, বুঝতাম না মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, না বুঝতাম কোথায় কোনে approach টা থাকা উচিত, তাই দাদার কাছে ক্ষেত সম্বোধনে ঘটা করে অনেক বার বকা খাওয়া হয়েছে। তার প্রায় এক বছর পরে এক শুক্রবার আমার বাবা ইন্তেকাল করেন। বাবার মৃত্যু আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবিয়েছিল। এই এক বছরে বাহ্যিকভাবে অনেকটাই স্মার্ট হয়েছিলাম যেমন শার্ট প্যান্ট পড়তাম,স্টাইল করে চুল কাটতাম। এখন বুঝি দেখতে বস্তি লাগতো! বাবার মৃত্যুর পর আমি বুঝতে পারি যে মা বাবা হল মাথার উপরে থাকা ছাতা কিংবা ছাদের মত: ছাতা যেমন রোদ বৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে; মা বাবা না থাকলে তেমন আপনাকে রোদেও পোড়াতে হবে বৃষ্টিতেও ভিজতে হবে।

বাবার মৃত্যুর পর দাদা আর দিদা আলাদা আলাদা বাসা নেন। আমি দাদার কাছেই থাকতে লাগলাম। ওনাদের টানাপোড়নের সংসার ছিল, দাদা সব সময় রাগান্বিত থাকতো; একদিন তুচ্ছ কারণে আমায় গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সেদিন মসজিদে গিয়ে অনেক কান্না করেছিলাম। আল্লাহ আমার কথা শুনেছিলেন। পরের দিন স্কুল থেকে আমার জন্য একটি অফার আসে। মূলত এই সময়টাতে আমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল, পরনে ভালো কাপড় ছিল না, জুতা জোড়া ছেঁড়া ছিল, খাতা কলম কিনতে পারতাম না; এমনকি স্কুলে ভর্তি হওয়াটাও সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে। আর এসব কিছু আমার স্কুল শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করেছে; আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছে এবং স্কুলে আমার থাকার একটা বন্দোবস্ত করেছে; বিনিময়ে তাদের স্কুলের দেখভাল করতে হবে আমাকে, এই যেমন পতাকা টাঙানো, গেট লাগানো ইত্যাদি।

তখন ক্লাস নাইনে। লেখাপড়ায় আমার অবস্থা খুবই খারাপ। এখনো মনে পড়ে জেএসসি এক্সাম এ বসে আমি আমার নামের ইংরেজি বানান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পাশের জনকে জিজ্ঞেস করাই বলল তোমার এডমিট কার্ডে দেওয়া আছে!

লেখাপড়ার পরিবেশ পাই ক্লাস টেনে। যেই পড়াটা ক্লাস ওয়ানে মানুষ শেখে সেটা আমি শিখেছি ক্লাস নাইন-টেনে। গণিত সাবজেক্টটা অনেক ভয় পেতাম। নিয়মিত ফেলও করতাম। খাতা কলম কিনার টাকা ছিল না। তাই মানুষজন পত্রিকা পড়ে ফেলে দিলে আমি তা সংগ্রহ করতাম আর তার উপর অঙ্ক করতাম। লেখার উপর লিখতাম। আলহামদুলিল্লাহ! অদ্ভুত ভাবে ক্লাস টেন এর টেস্ট পরিক্ষায় Commerce থেকে আমি প্রথম হয়ে গেলাম। পেলাম পুরু স্কুলে গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর ৮২! সেদিন আমি কেঁদে ছিলাম। খুব কেঁদেছিলাম, এই ভেবে যে আমার মাঝেও সম্ভাবনা আছে! আর আজ যদি আমার বাবা-মা থাকতো না জানি কত খুশি হত!!!

তখন আমাদের একাউন্টিং  ক্লাস নিত ফিরোজ স্যার নামে একজন শিক্ষক। খুব আদর করত। ক্লাস টেনের বিদায়ের দিনে। স্যারকে গিয়ে বললাম 'স্যার চলে যাচ্ছি একটু দোয়া করে দেবেন না?' স্যার এক গাল হেসে মাথায় 
হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল 'তোর এসএসসি পরীক্ষা শেষে যখন কলেজে ভর্তি হবি আমার সাথে দেখা করবি আমি তোর কলেজ ড্রেসটা বানিয়ে দিব', 

যাইহোক, এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। স্কুল জীবন শেষ হলো। কিন্তু এখন যাব কোথায়? সাময়িক সময়ের জন্য উঠলাম বোনের বাড়ি। এক রুম, নিজেরই লজ্জা লাগছিল। পকেটে জমানো ৫০০ টাকা! অপরিচিত পথঘাট। ৫০০ টাকা নিয়েই কাজের সন্ধানে চলে গেলাম ঢাকা। জানতাম না কীভাবে কাজ পেতে হয়। তখন শীতের সময়। কিছুদিন কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে রাস্তায় রাত কাটালাম। সেখানকার ঘটনাটা খুব দীর্ঘ তাই সংক্ষিপ্ত করছি। কিছুদিন থেকে সুবিধা করতে না পেরে রাস্তায় শাহাবুদ্দিন নামক এক ভাইয়ের সহায়তাই আবার গাজীপুর ফেরত আসতে সক্ষম হই। সেই ভাইয়ের উপকার আমি কখনো ভুলব না, এমনকি ভাইটির নম্বরও আমি সংরক্ষণে রেখেছি জীবনে যদি কখনো সফল হতে পারি তবে একবার ফোন করবো এই আশায়! এক রাত আবার আপুর বাসায় থাকার পর লজ্জা ভেঙে আপুর কাছে কিছু টাকা নিয়ে তিনদিনের 
তাবলিগ জামাতে চলে যাই। উদ্দেশ্য অন্তত তিন দিন মাথা গুজার জায়গা হবে!!

জামাতের দিন যতই ফুরিয়ে আসছিল ততোই চিন্তায় পড়ে যাচ্ছিলাম এখন যাব কোথায়? উল্লেখ্য বাবার মৃত্যুর পর আমি একটি স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্ন আমার মনোবল, ধৈর্য বহু গুনে বাড়িয়ে দেন। বুঝতে পারি আমার একজন রব আছে। যাইহোক, তিন দিন শেষে এক ভাই এসে ৪০ দিনের জন্য চিল্লাই যাওয়ার

অফার দিল। (চিল্লা মানে হচ্ছে বাড়ি ছেড়ে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে নিজ খরচে ভিন্ন কোথাও যাওয়া, এবং এই ৪০ দিন বাড়িতে ফেরা যাবে না)

কিন্তু শূন্য পকেটে কীভাবে হ্যাঁ করি। অথচ এস এসএসসি দিতে আরো তিন মাস বাকি। ভাইটিকে বললাম আমার মা বাবা বেঁচে নেই। তিনি বুঝলেন আমার হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন 'তুমি চিল্লায় যাও, ওখানে যাওয়ার পর টাকা লাগলে আমি দিবো আর সেখান থেকে এসে তুমি আমার হোটেলে কাজ করে এই ঋণ পরিশোধ করে দিও' 

সোসাইটি স্কুলের সামনে উনার পুরি, রুটি, কফি এসব বিক্রি করার দোকান ছিল। চিল্লা থেকে এসে ওনার দোকানে খাবার সার্ভ করার কাজ করে ঋণ মুক্ত হব এই ভাবনা নিয়ে ৪০ দিনের জন্য চিল্লাই গেলাম। ভালুকায় আমাদেরকে পাঠানো হয়েছিল। এই চল্লিশ দিন একাকিত্বের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। পাশাপাশি দ্বিনি জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয়েছিল। জীবন সম্পর্কে ভাবার অবকাশ পেয়েছিলাম। দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে দুশ্চিন্তার মাত্রাটাও বাড়ছিল! 

তারপর গন্তব্য কোথায় হবে? আলহামদুলিল্লাহ, মাত্র ১ হাজার টাকায় আমার ৪০ দিন চলে যায়; যেখানে অন্যদের তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। এটাকেই বোধহয় বারাকাহ বলে!! চিল্লা থেকে এসে ফাহিম ভাইয়ের হোটেলে কাজ করতাম, সারাদিন হোটেলে কাজ করতাম আর রাতে হোটেলেই ঘুমাতাম। 

অনেক বার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। আমার স্কুলের বন্ধুরা, ছোট ভাইরা যখন হোটেলে খেতে আসতো, তাদেরকে যখন আমি খাবার সার্ভ করতাম, আমার মোটেও লজ্জা লাগত না। কিন্তু খারাপ লাগতো যখন তারা আমাকে নিয়ে কানাঘুষা করতো। এভাবে তিন মাস শেষ হলো। 

যেহেতু স্কুলের শেষের দিকে গিয়ে ভালো রেজাল্ট করেছিলাম তাই আমার প্রথম সারির কিছু বন্ধু হয়। তাদের দেখাদেখি আমি কলেজ চয়েজের আবেদন করি। তারা গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজকে চয়েজ লিস্টের উপরে রেখেছিল। আমি তখনও অত বুঝতাম না। 

ওদের দেখাদেখি আমিও গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজকে সবার আগে রাখি; আর সময় ফুরালে জানতে পারি আমি গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে চান্স পেয়েছি। সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণে যখন জানতে পারলাম এখানে ভর্তি হতে ১২,০০০ টাকা লাগবে আর নিয়মিত ক্লাসের জন্য আমাকে হোটেলের কাজটাও ছেড়ে দিতে হবে তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! কারণ কাজটাকে অবলম্বন করেই আমার মাথার উপর এক খণ্ড ছাদ আছে; সেটাকে হারালে থাকবো কোথায়। বুঝলাম ফাহিম ভাইও আমার উপর অসন্তুষ্ট। 

কিন্তু আমাকে থামলে চলবে না কারণ আমি তো স্বপ্ন দেখি আমাকে আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিয়ে জান্নাতে যেতে হবে আর একদিনের জন্যও পরিচিত হয়েছি এমন সবাইকে নিয়ে আমি জান্নাতে যেতে চাই, এটা অত সহজ স্বপ্ন না, কারণ এই স্বপ্নপূরণে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে ফাইনান্সিয়াল ভাবে সিকিউর হতে হবে, হজ করতে হবে, মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমি যদি এখানেই থেমে যাই, তাহলে ফাইন্যান্সিয়াল ভাবে আমি কখনোই সিকিউর হতে পারব না, যে নিজেকে নিজেই সাহায্য করতে পারবেনা সে অন্যকে কীভাবে সাহায্য করবে?

হোটেলে কাজ করে জমানো টাকা, আপুর থেকে নেওয়া টাকা সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকার মত হল। আর অল্প কিছু টাকা হলেই ভর্তি হতে পারবো। খালার কাছে ফোন দিলাম উনি অপারগতা প্রকাশ করল, ছলছল চোখে ফোনে সেভ করা নাম্বার গুলো স্কল করছিলাম; কার কাছে ফোন দিয়ে একটু সাহায্য পাওয়া যায় এই আশায়। কিন্তু কয়েক জায়গায় ফোন দিয়ে রেসপন্স না পাওয়ায় যেটুকু আশা ছিল তা এক নিমিষেই ফুরিয়ে গেল। এমন একটা সময়ে দাঁড়ালাম আগামীকালই ভর্তির লাস্ট ডেট। নিরুপায় হয়ে ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম এই আশায় তাদেরকে কোনোভাবে ম্যানেজ করব। যেহেতু ওটা আর্মিদের কলেজ, তাই আমাকে তিনটি গেটের দারোয়ানকে অসহায়ের মত বুঝিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়েছে। প্রিন্সিপাল স্যারের গেটের সামনের দারোয়ান বলল প্রিন্সিপাল স্যার মিটিংয়ে আছে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে। মিটিং শেষ হলো, তারপর তিনি আমাকে জানালেন আরো একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার পালা শেষ হলে শক্ত গলায় বলে দিলেন তিনি আজ ক্লান্ত আমার সাথে কথা বলতে পারবেন না। আমি বললাম কালই ভর্তির সর্বশেষ ডেট,

মিস হয়ে গেলে আমি যে আর ভর্তি হতে পারবো না। তিনি আমার কথা শুনলেন না : কিছু স্যারের নাম বললেন সাথে এটাও বললেন তারা অনেক পাওয়ারফুল তাদের কাছে ব্যাপারটা তুলে দেখতে পারেন। আমি তাদের কাছে গেলাম, সবকিছু খুলে বললাম; এও বললাম এই বকেয়া টাকাটা আমি ভর্তি হওয়ার পর দিয়ে দিব, হাতজোড় করলাম। তারা আমাকে ফিরিয়ে দিল। সেদিন বাড়ি/ 19 ফেরার পথটা খুব দীর্ঘ ছিল। মনে মনে হিসাব নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এখানেই লেখাপড়ার ইতি।

পরদিন সকাল ৯:০০ টা নাগাদ আমার ফোনে কল আসলো। আমার বন্ধু শরীফ, ৪০ দিনের চিল্লাই তার সাথে পরিচয়। ফোন পিক করলাম, কৌশলাদি বিনিময়ের পর তিনি জানালেন তিনি গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে চান্স পেয়েছেন। 

আমাকে জিজ্ঞেস করলে বললাম আমিও। সে জানতে পারলো আমি ভর্তি হতে পারিনি। তাৎক্ষণিক সে আমাকে ১০০০ টাকা ধার দিল। আলহামদুলিল্লাহ সেদিন গিয়ে আমি ভর্তি হয়ে আসলাম, সর্বশেষ রোলটা আমার নামে বরাদ্দ হলো ৫১৭। আমার বন্ধু শরীফের এই উপকার কখনো ভুলবো না সে আমাকে কলেজের জন্য পড়িধেও একজোড়া জুতাও কিনে দিয়েছিল।

যেহেতু এই কলেজে নিয়মিত ক্লাস করতে হয়, ভাই হোটেলের কাজ বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিলাম। গাজীপুরে একটা বস্তিতে মাসিক ১,০০০ টাকা ভাড়ায় বাসা ভাড়া নিলাম। বই, কলেজ ড্রেস সহ নানা ধরনের প্রয়োজনীয়তা চোখের সামনে আসতে লাগলো। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব! এলাকায় নতুন হাওয়ায় কোন টিউশনো পাচ্ছিলাম না। যে শিক্ষক আমাকে বলেছিল- 'তোর এসএসসি পরীক্ষা শেষে যখন কলেজে ভর্তি হবি আমার সাথে দেখা করবি আমি তোর কলেজ ড্রেসটা বানিয়ে দিব' সেই শিক্ষক আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার পরের দিনই ইন্তেকাল করেন। শেষ পর্যন্ত কিছু পুরোনো বই, আর পুরোনো কলেজ ড্রেস ম্যানেজ করতে সক্ষম হই কিন্তু বইগুলো ক্লাসের সাথে মিলছিল না।

আর কলেজ ড্রেসটাও আমার শরীরের তুলনায় অনেক ঢিলে ছিল। এই ড্রেস পরে আমি কলেজে ঢুকলেই আমার সহপাঠীরা আমাকে প্রচণ্ড ট্রল করত। খুব কষ্ট হতো।। সম্ভবত বড়লোকের ছেলেপেলেরাই এসব কলেজে পড়ার সাধ্য রাখে।। যাইহোক, সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময় ছিল কলেজ লাইফটাই। আমার বাড়ি থেকে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছাতে আসা-যাওয়া ১০, ১০; ২০ টাকা পড়তো। হেঁটেই যাতায়াত করতাম; এতে অন্তত ৪ ঘণ্টা লেগে যেত। সেই বস্তি থেকে আপুর বাসা পাঁচ মিনিটের রাস্তা। যেহেতু ভোরে বাসা থেকে বের হতে হতো, আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে চারটা/পাঁচটা বেজে যেত তাই প্রতিদিন কলেজ থেকে এসে একবার করে আপুর বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতাম। আর বাকি বেলা না খেয়েই থাকতাম। কিন্তু একবার বাড়িওয়ালা আমায় গেটে পেয়ে যা ইচ্ছে তাই বলে বকে দিলেন।। পরিচয় দেওয়ার পরেও শক্ত গলায় বলে দিলেন এই বাড়িতে বাইরের মানুষ আসা নিষেধ। আমাকে যেন এই বাড়ির আশেপাশে না দেখা যায়। সেদিন নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছিল। এমনও আছে দুইদিন, তিন দিন পর্যন্ত আমার পেটে কিছু পড়েনি, দুই ঘণ্টা পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে কলেজ করেছি, কলেজে সহপাঠীদের ট্রলের শিকার হয়েছি, আবার দুই ঘণ্টা পথ হেঁটে বাড়ি ফিরেছি, প্রতিটা কদমে পেটের অসহনীয় আর্তনাদ শুনেছি। যেহেতু বস্তিটা নদীর পাশে ছিল, তাই বর্ষার মৌসুমে আমার ঘরে পর্যন্ত পানি উঠেছে। 

এমন অনেক হয়েছে সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে কাটিয়ে দিয়েছি। ঘরে সাপ, বিচ্ছু এসব প্রবেশ করত। একবার তো মস্ত বড় এক ঘুল সাপ টিনের বেড়া ভেঙে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে। ঘরে একখানা চেয়ার ছাড়া আর কিছুই ছিল না, ভয় পেলেই চেয়ারে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

একদিকে বই কিনতে পারিনি, কোনি শিক্ষক এর কাছে পড়ার আর্থিক সক্ষমতা ও ছিল না, তাই ক্লাসে কিছু না বুঝলেই প্রশ্ন করতাম, আর যেহেতু অন্যদের মত ক্লাস ৯ পর্যন্ত আমার অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া ছিল না তাই সম্ভবত আমার প্রশ্নের মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল। এজন্যও সহপাঠীদের কাছে অনেক ট্রল পেতে হয়েছে। অন্যদিকে আমার ছয় মাসের বেতন বকেয়া হয়ে গেছে।

একাধিক বার আবেদন করেও মওকুফ করাতে পারিনি। তারা বলল, এত সমস্যা নিয়ে কলেজে আসছো কেন! এখানে এসব বিষয়ে কোন ছাড় দেওয়া হয় না; তবে যারা ভাল রেজাল্ট করে তাদের বিষয়ে কিছুটা ভেবে দেখা হয়।বই না থাকায়, ক্লাসে বন্ধুদের বই পড়তাম, তাই বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যেতে পারতাম না, তারা কোথাও খেতে গেলে আমায় ডাকতো! কিন্তু শূন্য পকেটে কীভাবে যাই! পড়া আছে বলে না করে দিতাম। তাই আমার কোনো ভালো বন্ধু হয়ে উঠেনি। অনেকে ভাবতো আমি পড়া ছাড়া কিছুই বুঝিনা, এটা নিয়েও ট্রল করতো, কিন্তু বাসায় তো আমার বই নেই, পড়ার উপায় নেই, আবার তাদের সাথে চলার মত ফাইন্যান্সিয়াল এবিলিটিও নেই। তাদের ট্রল মাথা পেতে নিতাম! তারা তো আর জানত না আমি কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কলেজে আসা-যাওয়ার সময়টাই ইমেজিনেশন করতাম ক্লাসে কি পড়িয়েছে ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এই সময়টাতে গৌরবদার ভিডিওটি দেখি; নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছিল। এরপর থেকে যতবার হতাশ হয়ে যেতাম দাদার ভিডিওটি দেখতাম। সাহস ফিরে পেতাম।।

পরীক্ষার আগে স্যারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি তাদের কাছে যেহেতু বইয়ের একাধিক সৌজন্য কপি দেওয়া হয়, যদি কোন স্যার ম্যানেজ করে দিতে পারে। কিন্তু তারা আমার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেনি।। অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা আসলো, শুধু জানি এই পরীক্ষায় সেরা ২০ এর ভেতরে থাকতে পারলেই আমার বকেয়া বেতন মওকুফ হবে নয়তো এখানেই লেখাপড়াকে বিদায় জানাতে হবে। আমার একটাই ভালো বন্ধু হয়েছিল নাম তার সিয়াম। বাকি সবার সাথে হ্যালো হাই বাই বাই পর্যন্তই সম্পর্ক গড়িয়েছিল। তো সিয়াম আমার জন্য পরীক্ষার সময়গুলোতে সকাল সকাল কলেজে আসতো, তার ম্যাটেরিয়ালসগুলো  চোখ বুলিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকতাম, এই সময়টাতে রাস্তাঘাটেও পড়তাম। প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে প্রতিটা পরীক্ষা দিয়েছি। সময় গড়ালো, ফলাফলের দিন আসলো। প্রচণ্ড ভয় নিয়ে শেষের দিকে বসেছিলাম। একদিকে আমি লেখাপড়ায় দুর্বল, এখানে অধিকাংশই গোল্ডেন এ প্লাস আর আমি এসএসসিতে তে ৪.৩৩ পাওয়া শিক্ষার্থী, অন্যদিকে ক্লাসের সবাই আমাকে সবসময় বই নিয়ে বসে থাকতেই দেখেছে। 

তাই আমার রেজাল্ট যদি খারাপ হয় সবাই আমাকে নিয়ে অনেক ট্রল করবে। যাইহোক, ২০ থেকে রেজাল্ট অ্যানাউন্স করে আসছিল। ২০, ১৯, ১৮ এভাবে আসতে আসতে আমার পাশে বসে থাকা রাকিব পঞ্চম হয়েছে বলে ঘোষণা আসলো। সে উঠে গিয়ে মঞ্চ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করলেন। ততক্ষণে যা বুঝার আমি বুঝে গেছি, কারণ আমি বিশ্বাস করতাম আমার পক্ষে টপ টেনে থাকা তো সম্ভবই নয়। লজ্জায় কষ্টে মাথাটা বেঞ্চের উপর রেখে শুধু ভাবছিলাম, এবারের মত যদি বেঁচে যেতে পারতাম কতই না কষ্ট করেছি। এই ছয় মাসে, খাওয়া আর ঘুমের অভাবে শারীরিকভাবে একেবারেই শুকিয়ে গিয়েছি। নিজের চোখের সামনে নিজের শরীরের অবনতি দেখছি অথচ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার হাতে কিছুই করার নেই এর চেয়ে অসহায় মুহূর্ত আর কি হতে পারে!

যাইহোক, ততক্ষণে রাকিব পুরস্কার গ্রহণ করে এসে আমার পাশে বসলো। তার হাত আমার পিঠে রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছিল 'ব্যাপার না নাহিদ, সামনের বার দেখবে তুমি খুব ভালো করবে, কিন্তু সে তো জানে না এটাই যে আমার শেষ পরীক্ষা! চতুর্থ, তৃতীয়, দ্বিতীয়... এবার প্রথম কে হয়েছে তা ঘোষণার পালা। ঘোষণাকারী সবার উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন.. "বলতো প্রথম কে হতে পারে?" সবাই সমস্বরে উত্তর দিল "নাহিদ”, তখন লজ্জায় আমার ইচ্ছে করছিল মাটি খুঁড়ে নিচে ঢুকে যাই!!!... ঘোষণা করা হলো.. প্রথম হয়েছে রোল নাম্বার ৫১৭, নাহিদ হাসান!! আল্লাহু আকবার। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার কানকে।

এটা আমার কাছে মিরাকেল ছিল। এবার বাড়ি ফেরার পথটা বড্ড সংক্ষিপ্ত মনে হল। প্রথম যেদিন কলেজে এসেছিলাম মাথা ভর্তি অপমান নিয়ে ফেরার পথে প্রচণ্ড কান্না করেছিলাম। এবারও বাড়ি ফিরছি, সারাটা রাস্তা কান্না করেছি, কিন্তু এ কান্না কৃতজ্ঞতার!! আলহামদুলিল্লাহ, পরবর্তী মাসগুলোতে আমাকে কোন বেতন পরিশোধ করতে হয়নি। এক বছর শেষ হলো, এরই মাঝে হানা দিল করোনাভাইরাস।। যে বস্তিতে থাকতাম; বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিল তারা বস্তিটা ভেঙে ফেলবে। এখানে মাটি ফেলে নতুন বিল্ডিং তুলবে, তাই এই মাস পরেই রুমটা যেন ছেড়ে দেই। রুম ছেড়ে দিয়ে কলেজের সামনে ১৫শ টাকায় একটা মেসে উঠলাম। প্রচণ্ড শীত। বাবার মৃত্যুর পর থেকে, আমার কখনো দুটোর বেশি পাঞ্জাবি আর ট্রাউজার হয়নি। মাঝে মাঝে একটাই ছিল। পাঞ্জাবিতে অনেক সেলাই পড়তো। ক্লাস টেনের পর একবারের জন্যও সেলুনে যাওয়া হয়নি। কারণ চুল কাটানোর মত টাকা আমার হাতে ছিল না। নিজের চুল নিজেই কাটতাম। দু একদিন একটু খারাপ লাগতো, তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যেত।

বস্তিতে থাকতে যা মাঝে মাঝে আপুর বাসায় গিয়ে খেতে পারতাম এখানে রুম নেওয়ার পর সেই উপায়টাও আর নেই। অন্যদিকে কনকনে শীত, পরনে নেই কোন উষ্ণ পরিধেয়, না আছে কাঁথা, না আছে কম্বল। একটা শক্ত কাঠের উপর কোনোরকম শুয়ে থাকতাম। একমাত্র সঙ্গী ছিল ঘর ভর্তি মশা। মাঝে মাঝে শীতে নিশ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হতো। চেষ্টা করেও কোনো টিউশন পায়নি। 

কীভাবে পাব! না এখানে আমাকে কেউ চিনে, না আমি কাউকে চিনি। একবার এক স্যার আমাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিল। এক কেজি করে চাল আর লবণ কিনতাম শুধু। প্রতিদিন এক মুঠ চাল রান্না করতাম, এতে তিন-চার লোকমা  ভাত হতো। সকালে এক মুঠ, দুপুরে এক মুঠ, আর রাতে এক মুঠ করে লবণ দিয়ে ভাত খেয়ে কোন মতে দুই মাস সেখানে ছিলাম। সেই এক লোকমা  ভাতের স্বাদ অমৃত সমান !!

দুই মাস পর, এলাকার এক ভাই এর কাছে মনির স্যার সম্পর্কে জানতে পারলাম। তিনি মনির স্যারের অনেক প্রশংসা করলেন। তাই পরের দিন মনির স্যারের কাছে গিয়ে সবটা বললাম যাতে তিনি আমার জন্য একটা টিউশন ম্যানেজ করে দিতে পারেন। আলহামদুলিল্লাহ তিনি আমার জন্য একটি টিউশন ম্যানেজ করে দেন। সেদিনে তিনি আমার ঘরে আসেন, ঘর দেখে আমার জন্য তোশক, খেতা, কম্বল আর কয়েলের বন্দোবস্ত করে দেন। এরপর থেকেই মাঝে মাঝে তিনি আমার বাসায় আসতো। 

স্যার নিজের বাড়ির জন্য যা কিছুই কিনতো অল্প অল্প করে আমাকেও দিয়ে যেত। স্যারকে যতবার দেখেছি। অবাক হয়েছি। স্যার আমাকে সেই ভালোবাসাটুকু দিয়েছে যে ভালোবাসা একজন বাবা তার সন্তানকে দিয়ে থাকে। জীবন কিছুটা সহজ হলো। আর এই সময়টাতেই টুকটাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পড়াশোনা করতাম। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি A+ পেয়েছি। 

কলেজ জীবন শেষ হলো

এবার ভার্সিটির প্রস্তুতির পালা! কিন্তু হঠাৎ করেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। জ্বর, শারীরিক দুর্বলতা। অন্যদিকে, স্যারও প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ততদিনে যে টিউশনটা করাতাম তার পরীক্ষা শেষ (ssc). তাই শেষমেশ রুমটাও ছেড়ে দিলাম। আপুকে বললাম আমি অসুস্থ। আপু বলল তার বাসায় যেতে, তারা এখন দুটি রুম নিয়ে থাকে। তার ছেলেকে আলাদা একটি রুম দিয়েছে, আমি অন্তত কিছুদিন তাদের বাসায় থাকতে পারবো। অসুস্থ শরীর নিয়ে আমি আর পারছিলাম না তাই আপুর বাসায় চলে গেলাম। টাকার অভাবে কোন কোচিং এ ভর্তি হতে পারিনি। মনির স্যারের বলেছিল প্যারাগন কোচিংয়ে যেতে। ভেবেছিলাম স্যার হয়ত প্যারাগন কোচিংয়ের স্যারের সাথে কথা বলেছে। কিন্তু কোচিংয়ে গেলে প্যারাগনের পরিচালক যখন ভর্তি ফিস চাইল! বুঝলাম মনির স্যার সবটা খুলে বলেনি। অতীতের bad experience এর কারণে rejected হওয়ার ভয়ে সাহায্যটা চেতে পারিনি।

তবে নিজে বাসাতে পড়তাম আর কোচিং এসে মাঝে মাঝে পরীক্ষা দিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পরীক্ষার একমাস আগে আমার জলোবসন্ত হয়ে যায়, অন্যদিকে শারীরিক দুর্বলতাই একদম বিছানায় পড়ে যাই। তখন প্রচণ্ড

ভয় হতো, এক রকম বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম আমি হয়ত মরেই যাব। 

অন্যদিকে আপুর শাশুড়ি আপু আর দুলাভাইকে নানা রকম কান পড়া দিত, আমায় নিয়ে নানা আজেবাজে কথা বলতো, আমি তাদের কোন উপকারে আসবো না এটা সেটা। আমি শুধু শুনতাম, আপুর কাছেও বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম, আমার পড়ালেখাটাকে তারা সময় অপচয় বলে মনে করত। তাই আমার প্রস্তুতি নেওয়াটা একরকম নিজের সাথে যুদ্ধের পাশাপাশি পরিবারের সাথেও যুদ্ধ ছিল। কিন্তু জলোবসন্তের কারণে, আর বিছানায় পড়ে যাওয়ায় আমার খুব করে মনে হচ্ছিল যে আমি মারা যাব। তখন লেখাপড়া একেবারেই বন্ধ করে দেই।

পরীক্ষার আগের এক মাস আমি কোন বই টাচ করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার দিন গায়ে প্রচণ্ড জ্বর, হাতে বই নিলেই ডিপ্রেশনে ভুগতাম এই ভেবে যে যেটুকু সময় আছে আমি তো সব পড়ে একবারও রিভাইস দিতে পারব না। গায়ে জ্বর নিয়েই পরীক্ষা দিতে গেলাম। পরীক্ষার হলে মাথা একদমই কাজ করছিল না। এমসিকিউ ভালো করলেও রিটেনে ১৫ মার্ক একদম টাচ করতে পারিনি। আলহামদুলিল্লাহ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সি ইউনিটে ৫৬৫ তম স্থানে  
 এ চান্স পাই।

আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠি। ভেবেছিলাম চান্স পাওয়াতে জীবন সহজ হবে, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা ম্যানেজ করতে গিয়ে আরো একবার বেগ পেতে হয়। আর প্রথম বর্ষের প্রায় পুরোটাই একবেলা খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। ডিপার্টমেন্ট প্রেসার. হল এর প্রেসার এর উপর নিজের ব্যাক্তিগত প্রেসার। 

বর্তমানে: এখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রথম বছর হলেই থেকেছি। কিন্তু একবার হলের এক বড় ভাই বিনা দোষে আমার মাকে জঘন্য ভাষায় গালি দেন। আমি আমার মাকে কখনো দেখিনি, কিন্তু আমি আমার মার জন্য একজন সন্তানের অনুভূতি আমার অন্তরে ধারণ করি। সেদিন কেন যেন আমার মনে হয়েছিল, আমি

নিরুপায় হয়েই হলে উঠেছিলাম। যখন হলে ওঠা ছাড়া থাকার সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন বুঝে নিয়েছিলাম আমার সৃষ্টিকর্তা চাচ্ছে আমি হলে উঠি! আর যখন আমার মাকে জঘন্য ভাষায় গালি দেওয়া হল তখন আমার কাছে মনে হল আল্লাহর দুনিয়া অনেক বড়, কোথাও না কোথাও মাথা গুজার জায়গা ঠিকই হবে।

এখন আমি গাজীপুরে ছোট্ট একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকি, ডিসেম্বর মাস থেকে একটা টিউশন পেয়েছি। পাশাপাশি এখানে একটি কোচিং সেন্টার দেবার চেষ্টা করছি। জানি না জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, আমায় দোয়ায় রাখবেন।


সর্বশেষ সংবাদ