ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ডেইলি ক্যাম্পাস সাংবাদিককে জোটবদ্ধ হয়ে পেটাল শিবির-বৈষম্যবিরোধী নেতাকর্মীরা

আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ওয়াসিফ আল আবরার
আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ওয়াসিফ আল আবরার  © টিডিসি ফটো

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আবাসিক হলের সিটে থাকাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের ইবি প্রতিনিধি ওয়াসিফ আল আবরাররের ওপর হামলা চালিয়েছে শাখা ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শাখা সমন্বয়কদের একটি অংশ। এ ঘটনায় আবরারকে রক্ষা করতে গিয়ে লাঞ্ছিত ও আহত হয়েছেন সমন্বয়কদের অপর অংশের সদস্য, দুই সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) দিবাগত রাত আনুমানিক ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আজিজুর রহমান হলের দেশীয় ব্লকের ৪০৫ নং কক্ষে এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার জেরে ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের সাথে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অপরাংশের সাথে দফায় দফায় হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শাহ আজিজুর রহমান হলের ৪০৫ নম্বর কক্ষে অতিথি হিসেবে অবস্থান করছিলেন সাংবাদিক আবরার। এ সময় ৮-১০ জন শিবিরের কর্মী তার কক্ষে যেয়ে সে কেন ওই কক্ষে অবস্থান করছে তা জেরা করতে শুরু করে। কথাবার্তার একপর্যায়ে আবরার ছাত্রলীগ করে এমন অভিযোগ তুলে তাকে হল থেকে নেমে যেতে বলে তারা। সাংবাদিকের সাথে দুর্ব্যবহারের সময় আবরার ফোন বের করে তাদের ভিডিও ধারণ করে। বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে ভিডিও চলাকালেই তারা রুমে ঢুকে লাইট বন্ধ করে ফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং মারধর করে। 

এ সময় আবরারের রুমমেট ইমন এসে তাদের থামিয়ে দিয়ে আবরারকে সময় দেওয়ার অনুরোধ জানালে তারা ২ মিনিটে সব জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এসময় তারা আবরারের ফোনের ভিডিও ডিলেট করতে বারবার চাপ দেয়। সে ভিডিও ডিলেট করতে সম্মত না হলে আবারো তার উপর চড়াও হয়। এসময় তাকে টেনেহিঁচড়ে রুমের বাইরে বের করলে বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার সাবেক সেক্রেটারি সাজ্জাতুল্লাহ শেখ এসে তাদের হাত থেকে আবরারকে ছিনিয়ে নেয় এবং কোন অভিযোগ থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের না বললে সাজ্জাতুল্লাহর সাথেও বাকবিতন্ডায় জড়ায় শিবিরকর্মীরা। 

এ সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক নাহিদ হাসান, ইয়াশিরুল কবীর, তানভীর মন্ডল, মুবাশ্বির আমিন, শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আনোয়ার পারভেজ, তার অনুসারী তৌহিদ, অর্ক, আলামিন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ইসমাইল হোসেন রাহাত, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহমুদুল হাসান ছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও হলের শিক্ষার্থীরা।

এসময় আবরারকে ঘিরে টানাহেঁচড়া করে শিবিরকর্মীরা। শাখা শিবিরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক মোজাহিদ, ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক জাকারিয়া, আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের নাহিদ, আমির ফয়সাল, ২০২১-২২ সেশনের নাহিদ, সহ-সমন্বয়ক তানভীর মন্ডল, মুবাশ্বিরের সাথে অপর সহ-সমন্বয়ক নাহিদ, ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি রাহাত, সাজ্জাতুল্লাহ শেখ ও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ধস্তাধস্তি হয়। টি-শার্ট ধরে টানাটানির একপর্যায়ে ভুক্তভোগী আবরার গলায় আঘাত পান এবং মাথার পেছনে উপর্যুপরি আঘাতে কিছুক্ষণ পরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাকে ধরাধরি করে নিচে নামিয়ে ছাত্রদলের কর্মী রোকনুজ্জামান অর্ক এবং তালাবায়ে আরাবিয়ার সাবেক সেক্রেটারি সাজ্জাতুল্লাহ ইবি মেডিকেলে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য  তাকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা চলাকালীন বাইরে আবারও মারামারিতে জড়ায় দুই গ্রুপের শিক্ষার্থীরা। এ সময় সহ-সমন্বয়ক নাহিদ, সায়েম, রাহাত, তৌহিদ, রাকিবসহ উভয় গ্রুপের বেশ কয়েকজন আহত হয়। পরবর্তীতে মিছিল নিয়ে ভিসি বাংলোর সামনে গেলে সেখানে আরেক দফায় বাকবিতন্ডায় জড়ায় দুই গ্রুপের সদস্যরা। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন এবং ভিসির সাথে কথা বলতে বাংলোতে প্রবেশ করে। ঘটনা ঘটার ঘন্টাখানেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান এবং ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম ক্যাম্পাসে আসেন এবং প্রক্টর অফিসে উভয় পক্ষের সাথে মিটিংয়ের ডাক দেন।

ভুক্তভোগী সাংবাদিক আবরার বলেন, আমি শহীদ জিয়াউর রহমান হলের বৈধ সিটধারী হলেও নানা অজুহাতে আমাকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি। বিষয়টি আমি রমজানের মধ্যে জিয়া হলের প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টর এবং ভিসি স্যারকে জানালেও দেড় মাসে তারা কোন পদক্ষেপ নেননি। আবাসন সংকটে বাধ্য হয়ে আমি শাহ আজিজ হলের ৪০৫ নং রুমে কাছের বড় ভাই বাড়িতে থাকায় তার বেডে অবস্থান করছিলাম। গভীররাতে আচমকা কয়েকজন দরজা নক করতে থাকে এবং পরবর্তীতে আমাকে মারধর করে। আমি তখনি হল থেকে চলে যেতে চাইলেও নাহিদ ভাইরা আসায় তারা আবারো আমার উপর চড়াও হয়। চতুর্দিকের টানাহেঁচড়ায় আমার গলায় ফাস লেগে দম আটকে যায়। 

সহ-সমন্বয়ক তৌহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিবির এবং বৈষম্যবিরোধী একটি অংশ রাতের বেলায় হঠাৎ করে মব সৃষ্টি করে আবারের ওপর হামলা চালায়। পরে যখন আমরা তাদের কল পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাই, তখন তারা আমাদের ওপরও হামলা করে। হামলার কারণ হিসেবে তারা জানায় যে, 'জুলাই আন্দোলনে' শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিউজ লিখেছেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত কোনো ঝামেলার কারণে হামলা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে আমার জানা নেই।

‘রমজান মাসে ছাত্রশিবিরের ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক জাকারিয়া আমাকে দু'দফায় ফোন দিয়ে থ্রেট দেয়। আমাকে বলে, ক্যাম্পাসে যেন বেশি ঘুরাঘুরি না করি; যার রেকর্ড এখনও আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। আমাকে বলা হয় ছাত্রলীগের দোসর; অথচ জুলাই অভ্যুত্থানে আমার ভূমিকা কেমন ছিল- সেটা সবাই জানে।’—ভুক্তভোগী আবরার

শাহ আজিজুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এটিএম মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঘটনাটি আমরা জানতে পেরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। খুব শীঘ্রই তাদের প্রতিবেদন পাওয়া যাবে, এবং প্রতিবেদন পাওয়ার পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গতকালের ঘটনাটি আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। আমি যতটুকু জানি একটা সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে এই ঘটনাটি ঘটেছে। তারপরও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই এর একটি সুষ্ট তদন্ত করতে। তদন্তে যারাই দোষী তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

এর আগেও তাকে ‘ছাত্রলীগের’ দোসর ট্যাগ দিয়ে হুমকি দেওয়া হতো উল্লেখ করে সাংবাদিক আবরার বলেন, রমজান মাসে ছাত্রশিবিরের ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক জাকারিয়া আমাকে দু'দফায় ফোন দিয়ে থ্রেট দেয়। নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় আমি বিষয়টি প্রক্টর ও ভিসিকে লিখিত ভাবে জানালেও এতদিনেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি। আমাকে বলা হয় ছাত্রলীগের দোসর অথচ জুলাই অভ্যুত্থানে আমার ভূমিকা কেমন ছিল, ২ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের কাভার করা নিউজের স্ক্রিনশট প্রিন্ট করে প্রক্টর, ভিসি সবাইকে দিয়েছি। ক্যাম্পাসে এখনো পোস্টেড ছাত্রলীগের সহ-সভাপতিরা ঘুরে বেড়ায় অথচ ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। 

ইবির বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক নাহিদ হাসান বলেন, আবরারকে নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয় তখনি আমি ওর সমস্ত ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছি। আন্দোলনের সময় ও কী কী নিউজ করেছে তা আমি দেখেছি। সে এর আগেই ভিসি স্যারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবেন। আমি জানি না তারা সবসময় মবের অপেক্ষায় থাকে কিনা। যদি কাল প্রশাসন সঠিক পদক্ষেপ না নেয়, আমি একা হলেও ভিসি ভবনের সামনে বসে বিচার আদায় করবো।

এ বিষয়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার-সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় তদন্তে যদি শিবিরের কোন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যদি যাকে হামলা করা হয়েছে তার সাথে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তবে গভীর রাতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে রুম থেকে টেনে বের করে মারধরের দায়িত্ব শিবিরকে কে দিয়েছে- এমন প্রশ্নের ব্যাখ্যা মেলেনি হামলায় জড়িত ছাত্রশিবির কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারো কাছ থেকে।


সর্বশেষ সংবাদ