আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড : বেরোবির সিদ্ধান্তের ৪ মাস পরও অধরা অপরাধীরা
- আনোয়ার হোসেন, বেরোবি
- প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৭ PM , আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৬ PM

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নায়ক রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির সিদ্ধান্তের চার মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এখনো নেওয়া হয়নি কোনো আইনি ব্যবস্থা। আবাসিক হলের সন্ত্রাসীদের রুমে অস্ত্র পাওয়া গেলেও তাদের নামে আজও হয়নি কোনো মামলা। এতে আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৮তম সিন্ডিকেট সভায় শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দুই শিক্ষক ও সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেই ক্ষান্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই সভার চার মাস পেরিয়ে গেলেও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে প্রশাসন থেকে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।
পরে ২০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৯তম সিন্ডিকেট সভায় আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৭১ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সেমিস্টার অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা বোর্ড ২৩ জনকে এক সেমিস্টার, ৩৩ জন দুই সেমিস্টার ও ১৫ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের এত কম শাস্তি দেওয়ার কথা শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন-কর্মসূচি করলেও তা আমলে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলেও এখন পর্যন্ত নেই কোনো বাস্তব প্রতিফলন। অভিযুক্ত ১৫ জনের তালিকায় রয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি পমেল বড়ুয়া, সেক্রেটারি শামীম মাহাফুজ, ধনঞ্জয় কুমার টগর, গ্লোরিয়াস (ফজলে রাব্বি), বাবুল, বিধান, তানভীর, আদুল্লাহ আল নোমান খান, রিফাত, ফারহাদ হোসেন এলিট, মোমিনুল, আরিফুজ্জামান ইমন, গাজীউর, শাহিদ হাসান, মামুন।
দুই সেমিস্টার বহিষ্কার হওয়া ৩৩ জনের তালিকায় রয়েছেন সেজান আহমেদ ওরফে আরিফ, মো. আরাফাত রহমান আবির, আবু সালেহ নাহিদ, ইমরান চৌধুরী আকাশ, কফি আনান মান্নান, মাসুদুল হাসান, উজ্জ্বল মিয়া, হাবিবুর রহমান, সাখাওয়াত হোসেন, শোয়াইবুল সাল্লু, আব্দুল্লাহ আল রায়হান, বায়েজিদ মোস্তাফী, রাসেল, সিয়াম আল নাহিদ, অমিত, আখতার হোসেন, তানজিল, মুন্না হাসান লিওন, জিহান আলী, মো. সাব্বির হোসেন রিয়ান, গালিব হাসান, মাহমুদুর রহমান হৃদয়, মো. মোশারফ হোসেন, পিপাস আলী, মোজাম্মেল হক, মৃত্যুঞ্জয় রায়, মো. সাজ্জাদ হোসেন, মানিক চন্দ্র সেন, রবীন্দ্র রায়, সিয়াম আরাফাত, মো. সাব্বির আহমেদ, মো. মুসান্না-বিন-আহমেদ, শাহীন ইসলাম।
এক সেমিস্টার বহিষ্কার হওয়া ২৩ জনের তালিকায় আছেন, মো. হাসানুজ্জামান সৌমিক, সুদীপ্ত সরকার বাঁধন, জুবায়ের মাহমুদ, কোমল দেবনাথ, মো. রিজন মন্ডল, মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, ফিলিপ রায়, জিহাদ উল্লাহ, এস এম লাবু ইসলাম, জয়ন্ত চন্দ্র রায়, সবুজ কুমার, সবুজ হাসান মিরাজ, জামাল মিয়া, তৌফিক কিবরিয়া, মেজবাহুল সরকার জয়, দেবাশীষ কুমার রায়, আতেফ আসহাব দিল মণ্ডল, নাফিউল ইসলাম, তপন চৌধুরী, সাজেদুর রহমান, আমিরুল ইসলাম শুভ, শফিউল আযম ওরফে সম্রাট।
এ ছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দিনের বিভিন্ন মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ঘটনাস্থলে উপস্থিতি প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। এমনকি তদন্ত কমিটিও তাদের তদন্তের আওতায় আনেনি।
তাদের মধ্যে সাবেক ভিসির পিএ নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, পরিবহন পুলের উপপরিচালক তাপস কুমার গোস্বামী, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার শাহিন মিয়া ওরফে শাহিন সর্দার, পেনশন শাখার উপপরিচালক রিয়াজুল ইসলাম, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর নুরুজ্জামান, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে কর্মচারী বিপ্লব, বহিষ্কৃত সেকশন অফিসার মনিরুজ্জামান পলাশ, ডেসপাস শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তারুল ইসলাম, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাসুম খান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মচারী ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মাহবুবার রহমান, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মচারী ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলম মিয়া, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার উপ-রেজিস্ট্রার হাফিজ আল আসাদ রুবেল, মার্কেটিং বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর আহসান হাবীব তুষার, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সেকশন অফিসার এ কে এম রাহিমুল ইসলাম দিপু, প্রক্টর অফিসের কর্মচারী মো. আপেল এবং সংস্থাপন শাখা-১ এর কর্মচারী সবুজ মিয়াকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়।
আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ছাত্রলীগ ও পুলিশের পাশে দেখা গেছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলম মিয়াকে। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে একটি বড় ইট হাতে তাকে দেখতে পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যাদের এক বা দুই সেমিস্টার বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে আবু সাঈদ হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের শাস্তি স্থায়ী বহিষ্কার। আর হত্যার শাস্তি হয় ড্রপ সেমিস্টার।’
এ বিষয়ে আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন বলেন, ‘আমরা চাচ্ছিলাম যারা আহত তারাই শুধু সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু তারা অধিকাংশই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ না করায় আমরা এখন নিজেরাই সাক্ষ্য দেব।’
আবু সাঈদের সহযোদ্ধা এস এম আশিকুর রহমান বলেন, ‘আমার অপরাধীদের নামে মামলা করার জন্য সাক্ষীর তালিকা তৈরি করছি। দ্রুতই সাক্ষীর তালিকা প্রশাসনের কাছে জমা দেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী শাহরিয়ার বলেন, ‘এখন সবাই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। প্রশাসন ব্যস্ত তাদের নিজের কাজে আর সমন্বয়করা ব্যস্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে। তারা সবাই আজ ভুলে গেছে আবু সাঈদকে। দুঃখজনক বিষয়, বারবার কমিটি গঠন এবং সংবাদ সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আশ্বাস।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো ফেরদৌস রহমান বলেন, ‘দুজন শিক্ষক ও সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আমার তিনবার নোটিশ দেব। এরপরও কোনো উত্তর না পেলে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে। আর তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য উপচার্য স্যার হয়তো দ্রুতই আইনি ব্যবস্থা নেবেন।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। আবু সাঈদ ও তার সহপাঠীদের ওপর হামলাকারীদের শিগগিরই বিচারের আওতায় আনা হবে। সন্ত্রাসীরা কেউই ছাড় পাবে না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করব। কোনো অপরাধীকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।’