সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার শঙ্কা

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন। রবিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোলা হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন। রবিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোলা হয়েছে।  © সৌজন্যে প্রাপ্ত

সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়ন হলে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হতে আগ্রহী হবে না, এতে মেধার অবমূল্যায়ন হবে, শিক্ষকদের মর্যাদা হ্রাস এবং সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হবে বলে মনে করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। বিপরীতে দেশের সরকারি উচ্চশিক্ষালয়গুলোর শিক্ষকদের এ সংগঠনের দাবি, এ স্কিম প্রত্যাহার করে আগের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার। এছাড়াও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোয় সুপার গ্রেড বহাল রাখা চলমান সংকটের সমাধান দিতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষকরা।

বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন নিজেদের অবস্থান জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিরে মাধ্যমে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে—বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ সব কর্মসূচিতেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এ স্কিমের বাইরে রাখার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়াও মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ আলোকিত মানুষদের দাবি ছিল দেশের সকল শিক্ষা স্তরেই সকল শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক একটি গ্রেড চালু করার।

আমরা ফেডারেশন থেকে এ স্কিম প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। দাবি না মানা হলে আমাদের সংগঠনের সকলের মতামতের ভিত্তিতে আরও বৃহৎ কর্মসূচি আসতে পারেঅধ্যাপক আবদুল হক, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। 

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বলছে, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে থাকাদের জন্য সর্বজনীন স্কিমের যে ব্যবস্থা সরকার করেছে তা যথেষ্ট ভালো উদ্যোগ। তবে সেখানে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরও সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষকদের ওপর এ স্কিম বাস্তবায়ন করা হলে তাদের বিদ্যমান বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে। ফলে নবীন মেধাবী শিক্ষার্থী যারা রয়েছেন তারা শিক্ষকতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন এবং মেধাবীদের ওপর এর একটি প্রভাব পড়বে। তারা শিক্ষকতায় আসবে না।

এছাড়াও মেধার অবমূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পাবে এবং একটি বৈষম্য পূর্ণ অবস্থা তৈরি হবে বলেও মনে করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। সেজন্য এটি বাতিল করে পূর্বের ন্যায় নিজেদের স্বতন্ত্র কাঠামো এবং সুপার গ্রেড বাস্তবায়ন চান ১৬ হাজার শিক্ষকদের এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

আরও পড়ুন: প্রস্তাবকারীরাই সর্বজনীন পেনশনে থাকতে চান না, শিক্ষকদের বলে ‘আপনারা তো অতুলনীয়’

সরকারের নতুন এ উদ্যোগ চলতি বছরের জুলাইয়ের আগে যোগদানকৃত এবং ১লা জুলাই ২০২৪ এবং তার পরে যোগদানকৃতদের মধ্যে দুটি শ্রেণির জন্ম দেবে জানিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফলে একই কর্মক্ষেত্রে অবস্থানরত সহকর্মীদের মধ্যে এই বিভাজন শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সাথে এই ব্যবস্থা সরকারি অন্যান্য চাকরিজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য তৈরি করবে, যা সংবিধানের সমতার নীতির পরিপন্থি।

বর্তমান ব্যবস্থায় পেনশন বাবদ কোনো অর্থ কর্তন করা হয় না। ‘প্রত্যয়' স্কিমে মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা ৫০০০ টাকা (যেটি সর্বনিম্ন) হারে টাকা কর্তন করার বিধান রয়েছে জানিয়ে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক প্রাপ্য হন। ‘প্রত্যয়’ স্কিমে আনুতোষিক শূন্য। বিদ্যমান পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশন প্রাপ্ত হন। ‘প্রত্যয়’ স্কিমে পেনশনারের মৃত্যু হলে নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পূর্তি হওয়া পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্ত হবেন। ফলে এটি চলমান ব্যবস্থায় সংকট তৈরি করবে।

এখানে নীতিগত কিছু সংকট এখনও বিদ্যমান রয়েছে। আমরা তা উত্তরণের উপায় খুঁজছি। আশা করছি, দ্রুতই এটি করা সম্ভব হবেমো. মাহমুদুল হক, অর্থ বিভাগের উপসচিব, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

এছাড়াও বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনের ওপর বৎসরিক ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট, বিদ্যমান ব্যবস্থায় অর্জিত ছুটি নগদায়নের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ বছর। প্রত্যয় স্কিমে অবসরকালীন বয়স স্থির করা হয়েছে ৬০ বছর, বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনের সাথে মাসিক চিকিৎসাভাতা, বছরে দুটি উৎসবভাতা ও একটি বৈশাখি ভাতাসহ নানা বিষয়ে অসন্তোষ রয়েছে দেশের সরকারি উচ্চশক্ষালয়গুলোর শিক্ষকদের।

বিষয়টি নিয়ে কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাবি) শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়ার সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি বৈষম্যপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন আমলারা। আমরা এর বিপরীতে এটি বাতিল করে পূর্বের ন্যায় নিজেদের স্বতন্ত্র কাঠামো এবং সুপার গ্রেড বাস্তবায়ন চাই।

আরও পড়ুন: ৩০ জুনের মধ্যে পেনশন স্কিম বাতিলে আল্টিমেটাম ঢাবি শিক্ষক সমিতির

এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশের স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্টায়ত্ত্ব, সংবিধিবদ্ধ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যয় স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরপর থেকেই সর্বজনীন পেনশন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সুপার গ্রেড কার্যকর ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। তাদের দাবি না মানা হলে আগামী ২৮ মে ২ ঘণ্টা ও ৪জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করার কথা জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এসব দাবি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে তারা ইতোমধ্যে বৈঠক করেছেন। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে শিক্ষকদের বিষয়গুলো গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁর কাছেও আমরা আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরবো। আশা করছি, তিনি আমাদের দাবিগুলো পূরণ করবেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশের স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্টায়ত্ত্ব, সংবিধিবদ্ধ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যয় স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আর দাবি না মানা হলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচিতে যেতে পারেন শিক্ষকরা। এর মধ্যে বৃহৎ পরিসরে কর্মবিরতি আসতে পারে। আর শিক্ষকরা কর্মবিরতিতে গেলে দেশের উচ্চশিক্ষালয়গুলোয় ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে অনেকটাই অচলাবস্থায় পড়তে পারে সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সাধারণ মানুষদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনা হয়েছে, তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মেলানোর দরকার নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি এবং চবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা ফেডারেশন থেকে এটি প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। দাবি না মানা হলে আমাদের সংগঠনের সকলের মতামতের ভিত্তিতে আরও বৃহৎ কর্মসূচি আসতে পারে।

আরও পড়ুন: বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে জাবি শিক্ষকদের মানববন্ধন

দেশের অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীদের বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এভাবে এককভাবে পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এটি বন্ধ করে আমাদের সুপার গ্রেডে স্বতন্ত্র কাঠামোতে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হোক। এছাড়াও এটি মেধাবীদের শিক্ষকতায় অনুৎসাহিত করার পাশাপাশি মেধার অপচয় করবে—যুক্ত করেন অধ্যাপক আবদুল হক।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জাতীয় সর্বজনীন পেনশন স্কিমের জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষে কর্মরত অর্থ বিভাগের উপসচিব মো. মাহমুদুল হক বলেন, এখানে নীতিগত কিছু সংকট এখনও বিদ্যমান রয়েছে। আমরা তা উত্তরণের উপায় খুঁজছি। আশা করছি, দ্রুতই এটি করা সম্ভব হবে। এছাড়াও সামনের দিনগুলোতে সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে পেনশন কার্ড বাধ্যতামূলক করা হলে সবাইকে এর আওতায় আসতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ