ফিরে দেখা ২০২০: বছরের শুরুতেই শান্ত ক্যাম্পাস হয় অশান্ত

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়, চট্টগ্রাম
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়, চট্টগ্রাম   © ফাইল ফটো

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য আর কোলাহলে মুখর ও সৌন্দর্যে আগের বছরগুলোয় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়, চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) ক্যাম্পাস সবাইকে আকর্ষণ করে গেছে। তবে এ বছর প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে সব। তবে শত বাধার মুখেও সাফল্য ছুঁতে এগিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রা।

১৯৯৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সংকট এবং সমস্যার মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলেছে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি। এসব সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিবছর চেষ্টা করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, বিদায় নিতে চলা ২০২০ সালে অস্থিতিশীলতা, দ্বন্দ্ব, ক্যাম্পাস বন্ধ, আন্দোলন, সংঘর্ষ, রাজনীতি নিয়ে বছরজুড়ে নানান ইস্যুতে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাসটি।

সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলো শিক্ষক নির্যাতন, আবরারের মতো আইআইইউসির এক ছাত্রকে নির্যাতন, এরপর ছাত্র অসন্তোষ, অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ, হল বন্ধ, মামলা, ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান ও তিন শিক্ষকসহ ছয় জন গ্রেপ্তার হওয়া। এ বছরে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিয়ে এবারের আয়োজন ফিরে দেখা ২০২০।

লাঞ্ছিত আইআইইউসি শিক্ষক, বন্ধ ঘোষণা ইইই বিভাগ

গত ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের চেয়ারম্যানের সাথে বেশ কয়েকজন উশৃঙ্খল ছাত্র গালিগালাজ, বাকবিতণ্ডা ও অশালীন আচরণ করে। এছাড়া নানাবিধ হুমকি প্রদান ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এমনকি গত বছরের এপ্রিলে এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা ওই বিভাগে হামলা ও ভাংচুর করে। পরে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় (ইইই) বিভাগের সব ধরণের অ্যাকাডেমি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন বিভাগের শিক্ষকরা। বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মাদ শামিমুল হক চৌধুরী লাঞ্ছনার ঘটনায় এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান তারা।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ইলেক্ট্রিকেল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ক্লাস রুমসহ বিভিন্ন সংকট নিরসনে ১৩ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ইইই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শাফায়েত হোসাইনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬ সালে যখন ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব জায়গায় আসতে বলে, তখন সিএসই ডিপার্টমেন্ট ছিলো চট্টগ্রাম শহরে। সে সময় সিএসই বিভাগের ছাত্রদের সুবিধার্থে ইইই ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর ছেড়ে দেয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে ওই বিভাগকে একটি ভবন দেয়ার পরও তারা আমাদের ভবন ছেড়ে দিচ্ছে না। আমরা এ ব্যাপারে অথরিটির সাথে কথা বলি। তারা আমাদের শুধু আশ্বস্ত করে গেছেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।’

আবরার স্টাইলে ছাত্র নির্যাতন

বিশ্বববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে বুয়েটের আবরার স্টাইলে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। গত ২৭ জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসমান (রা) হলে রড, লাঠি ও স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় ওই শিক্ষার্থীকে। এতে অংশ নেন ছাত্রলীগ পরিচয় দেওয়া আইন বিভাগের ছাত্র উ চো মারমা, রবিউল ইসলাম রনি, শফিউল ইসলাম, অনিক ও মৃদুল। পরে খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই ছাত্রকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

মারধরের ঘটনায় ভুক্তভোগী ছাত্র মাসুদুর রহমান আদনান বাদী হয়ে মামলা করেন।  ৬ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২,  তিনি এ মামলা করেন। তারা সবাই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ‘কথিত’ নেতা দাবি করেন। আইন বিভাগের ছাত্র উচো অং মারমাকে ১নং আসামি করে মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই মামলা দায়ের করা হয়। 

ছাত্র অসন্তোষের জেরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস, হল বন্ধ

ওই ছাত্রকে মারধরের ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মুখোমুখি অবস্থানে ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় । ২৯ জানুয়রি বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার কর্নেল মুহাম্মাদ কাশেম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ পরিচয়ে বারবার শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্যাতনের প্রতিবাদে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সামনে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হয়। ৩০ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার বিকেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের উদ্যোগে এ কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়। এছাড়া গত ২৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে ইইই বিভাগের শিক্ষক শামীমের সাথে বাকবিতন্ডা হয়। পরে কৃত্রিম সংকট তৈরী করার অভিযোগ এনে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনে করে ছাত্রলীগ।

প্রক্টরের পদত্যাগ

ছাত্রলীগের সাথে অসন্তোষের পরিপ্রক্ষিতে প্রক্টরসহ প্রক্টরিয়াল বডির পাঁচ সদস্য দায়িত্ব থেকে অব্যহতি চান। পদত্যাগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কাওছার আহমেদ বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরিস্থিতির কারণে পদত্যাগপত্র জমা দেইনি। বরং আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ।’ নতুন প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ পান বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তফা মুনির চৌধুরী। ৯ ফেব্রুয়ারি রেজিস্টার কর্ণেল ( অব.) মো. কাশেম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাকে এ নিয়োগ প্রদান করে। একইসঙ্গে ১৫ জন শিক্ষককে সহকারী প্রক্টর হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হয়।

ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ

সামগ্রিক ঘটনার আলোকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পক্ষে এ ঘোষণা পাঠ করে শোনান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কর্নেল মোহাম্মাদ কাশেম (অবসরপ্রাপ্ত)।

এদিকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে আইআইইউসি’র ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গত ৩ মার্চ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইওয়ে সংলগ্ন মূল ফটক থেকে সিকিউরিটি বক্স পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। সিকিউরিটি বক্সের পাশে যাওয়ার পর প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা এসে তাদের চলে যেতে বলে। পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রেলবিটে অবস্থান নেয়। এসময় শিক্ষকরা তাদের বুঝিয়ে সেখান থেকে বিদায় করে দেন।

ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিস্কার

শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ছাত্র নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় ২ শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাছাড়া আরও ৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের বহিষ্কার করা হয়েছে। বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বহিষ্কৃতরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।

উপাচার্যকে সুপ্রিম কোর্টে তলব

আইআইইউসি উপাচার্যকে সুপ্রিম কোর্টে তলব ও ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আইন বিভাগের এলএলবি কোর্সে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায় উপাচার্যকে আদালতে তলব ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

করোনাভাইরাসে ক্যাম্পাস বন্ধ

করোনাভাইরাসের কারণে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে বলে নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত আইআইইউসিতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকার ঘোষণা দেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়ে পড়ায় সতর্কতার অংশ হিসেবে কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

মামলা, গ্রেফতার

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে (আইআইইউসি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা হয়। ওই মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আ ন ম শামসুল ইসলাম ও সদস্য আহসান উল্লাহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে আসামি করা হয়ে। চার শিক্ষক হলেন, মাহবুব রহমান, কাউছার আহমেদ, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও নিজাম উদ্দিন। পরে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। সর্বশেষ তারা জামিন নিয়ে বের হন।

সিমাগো-স্কপাস র‌্যাংকিং

বিজ্ঞান গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত সিমাগো-স্কপাসের ইনস্টিটিউশনস র‌্যাংকিংয়ে প্রথমবারের জায়গা করে নেয় দেশের তিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে জায়গা করে নেয়- ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম (আইআইইউসি)।

ছাত্র হত্যা

রাজধানীর হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে অজ্ঞাতনামা এক যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে তার হত্যার রহস্য উন্মোচন করে পুলিশ। গত ১২ অক্টোবর লাশটি উদ্ধার করা হয়। আজিজুল ইসলাম মেহেদী নামের ওই যুবক চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) ছাত্র ছিলেন। তিনি আমেরিকা প্রবাসী বাবার একমাত্র ছেলে। বয়স ২৪ বছর।

মেহেদী আন্তর্জাতিক ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। আমেরিকা প্রবাসী বাবার একমাত্র ছেলে। আজিজুল ইসলাম মেহেদীর জন্ম চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপের বাউরিয়া গ্রামের হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে মাকে নিয়ে চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ এলাকায় থাকতেন। লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। লেখাপাড়ার পাশাপাশি পরিচিতজনদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিংয়ে সহায়তা করতেন মেহেদী।


সর্বশেষ সংবাদ