সংস্কার—নাকি নির্বাচন, কি ভাবছেন ডিআইইউ’র ছাত্রনেতা ও শিক্ষার্থীরা
- ডিআইইউ প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩২ PM , আপডেট: ২২ জুন ২০২৫, ০৫:০৮ PM
দেশের রাজনীতির মাঠ যখন উত্তাল, তখন শিক্ষাঙ্গনেও বইছে সেই উত্তেজনার ঝড়। জাতীয় নির্বাচন আগে, নাকি রাষ্ট্র সংস্কার—এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত পুরো রাজনৈতিক অঙ্গন। তবে এই বিতর্ক শুধু রাজনীতিবিদদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; তরঙ্গ তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও। রাজধানীর অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ডিআইইউ) এ নিয়ে চলছে উত্তপ্ত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ও মতপার্থক্য। ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নিজেদের অবস্থান নিয়ে ভাবছেন, বলছেন, প্রশ্ন করছেন। তাদের সেসব কথা শুনেছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের ডিআইইউ প্রতিনিধি নুর ইসলাম।
ডিআইইউ ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল হাসান চাঁদ বলেন, নির্বাচন এবং সংস্কার দুইটি জরুরী। ছাত্রনেতারা সংস্কারের কথা এখন ভাবলেও আমাদের নেতা জনাব তারেক রহমান সংস্কারের কথা ভেবেছেন সেই ২০১৬ সালে। বর্তমানে সংস্কারের কথা বলা হলেও মূলত কোন সংস্কার করা হচ্ছে না। আমরা মনে করি নির্বাচনের রোড ম্যাপ দিয়ে দিলে সংস্কার খুব দ্রুত হবে।আমাদের মনে রাখতে হবে নির্বাচন একটা বড় ধরনের সংস্কার এবং আমরা যদি কোন নির্বাচিত সরকারের অধীনে সংস্কার করি তাহলে সেটা হবে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য এবং টেকসই।
তিনি আরও বলেন, মুখে সংস্কারের কথা বলেও কাজে যদি কেউ সংস্কার না করে ক্ষমতায় থাকার জন্য সংস্কার সংস্কার বলে নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে নির্বাচন চাওয়াটা দোষের কিছু হবে না বরং নির্বাচন চাওয়া একটা গণতান্ত্রিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার।
ডিআইইউ বৈছাআ'র আহ্বায়ক মোঃ রফিকুল ইসলাম প্রামানিক, জুলাই আগষ্ট ছাত্র জনতার গনভুথ্যানের মাধ্যমে ৫ আগস্ট ওই ফ্যাসিস্ট সৈরাচার খুনি রাতের ভোটের অবৈধ আওয়ামী সরকারের পতন হয়। আমরা আন্দোলন শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্য করিনি।
খুনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ছাড়া আগামীর নির্বাচন গ্রহণ করা হবে না। বিপ্লবী সরকার যদি ছাত্র-জনতার সাথে বেইমানি করে আওয়ামী লীগ কে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করে,জুলাইয়ে শহীদের রক্তের শপথ করে বলছি এই সরকারের বিরুদ্ধে আরো একটি বিপ্লবের ডাক দেওয়া হবে। 'র' এর প্রেসক্রিপশনে আগামীর নির্বাচন ঠিক হবে না,আগামীর নির্বাচন ঠিক করবে বাংলাদেশের জনগন।
তিনি আরও বলেন, এই আন্দোলনে ২২ হাজার আহত ও ২ হাজার শহিদ হয়েছেন শুধু মাত্র একটি নির্বাচনের জন্য নয়। আমি মনে করি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে আবু সাইদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ সহ নাম জানা দুই হাজার শহিদদের রক্তের সাথে বেইমানি করা হবে। আমি স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করতে হলে আমরা যারা বিপ্লবীরা বেঁচে আছি আমাদের রক্তের উপর দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। খুনি হাসিনার পতন নির্বাচনের জন্য করিনি করেছি দেশ সংস্কারের জন্য। তাই আগে দেশ সংস্কার তারপর নির্বাচন।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় সংগঠক মো: মুহতাসিম ফুয়াদ বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান ছাত্ররাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতিতে বারবার উঠে আসে এক প্রশ্ন—নির্বাচন আগে, না সংস্কার? একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অবশ্যই গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিদ্যমান যে কাঠামোটি বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, সেটি সংস্কার না করে পুনরায় নির্বাচন আয়োজন কি কার্যকর হবে?
আমি মনে করি, নির্বাচন একটি ফল, কিন্তু সংস্কার হলো গাছের শেকড়। যদি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি, এবং রাজনৈতিক সহিংসতা সংস্কার না করা হয়, তবে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, কিছু মহল মনে করে, দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। তবে বাস্তবতা হলো, টেকসই গণতন্ত্রের জন্য দুইটিরই প্রয়োজন—আগে প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার, তারপরে নির্বাচন। কারণ, মেরামত ছাড়া ভাঙা ছাদে বসবাস করা যায় না।
সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো: শামীম মাতুব্বর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের দমন-পীড়ন, গুম-খুন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ছিল এক গণবিস্ফোরণ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের ফলে সরকার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনে ২০০০-এর বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, বহু মানুষ আহত ও পঙ্গু হন। এর মূল লক্ষ্য ছিল একটি সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া।
তবে এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের প্রতিফলন এখনো স্পষ্ট নয়। তারা কিছু সংস্কার করতে চাইলেও কিছু রাজনৈতিক দল তাদের সময় দিতে নারাজ, যেন সবকিছু কেবল নির্বাচনের জন্যই হয়েছে। অথচ জনগণ চায়, আগে কাঠামোগত সংস্কার হোক—যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার না জন্মায়। তাই জনগণ চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দেওয়া হোক প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য। সব রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ, নিজেদের স্বার্থ নয়, জনগণের ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দিন। প্রয়োজনে হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে জনগণের মত জানুন। তাহলেই দেশের ও মানবতার কল্যাণ সম্ভব হবে।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ বলেন, নির্বাচন না কি সংস্কার—এই প্রসঙ্গে বললে, আমি সবসময় নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দেব। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ একটি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর, দেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা একটি নির্বাচিত সরকারের হাতেই সুরক্ষিত থাকতে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান রক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে নির্বাচন অপরিহার্য।
তবে, নির্বাচন কমিশনের সংস্কারও জরুরি। নির্বাচন প্রক্রিয়া যেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। কিন্তু সংস্কারের কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়া উচিত নয়। বরং দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামত প্রতিফলিত করে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশের সংস্কারের ভার তুলে দেওয়া উচিত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো: মিয়াদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে দুর্নীতি ও বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার বেড়েছে। এসবের মাধ্যমে রাজনীতির নামে অপ-রাজনীতি ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার প্রবণতা দেখা গেছে। এর একটি বড় উদাহরণ হলো কোটা আন্দোলন, যা কেবল কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রূপ নেয়। পরে সেই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
তবে দীর্ঘ ১৭ বছরের দুর্বল রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনর্গঠনে সময় লাগবে। নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন, যেমন শাসন ব্যবস্থার স্বাধীনতা, দুর্নীতিবাজ আমলাদের অপসারণ, শহীদ পরিবারকে সহায়তা, দোষীদের শাস্তি, লুট হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা। এসব ছাড়া নতুন সরকার পুরনো স্বৈরাচারী পন্থা অনুসরণ করতে পারে, যার ফলে আবার দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ভোট জালিয়াতি ও জনবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করা উচিত, যাতে একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।