বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেখে নয়, শর্ত পূরণ করলে বেসরকারিতে পিএইচডি মিলবে
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের গোলটেবিল বৈঠক
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১০:২৭ PM , আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৩:৫৬ PM
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য বিশ্বমান এবং দেশীয় চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। এই নীতিমালা অনুযায়ী যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শর্ত পূরণ করবে সে বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু বা পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হবে।
আজ মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারস্থ লা ভিঞ্চি হোটেলে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি নীতিমালা: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইউজিসির সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ও পিএইচডি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, শিক্ষা-গবেষণায় দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর ক্ষেত্রে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম আছে বলে আমরা (ইউজিসি) অনুমোদন দেব, সেটি হবে না। নীতিমালাই নির্ধারণ করে দেবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে এটার অনুমোদন দেয়া যাবে। সেটি ইউজিসি, কোনো কমিটি কিংবা ব্যক্তির তা নির্ধারণ করা সুযোগ থাকবে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির নীতিমালা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সেটি এমনভাবে করা হবে, যাতে কোনো প্রশ্ন উঠবে না এবং সনদ বাণিজ্যের কোনো প্রশ্নও উঠার সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে নীতিমালার একটি চেকলিস্ট থাকবে এবং সেখানে যারা (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ঘর পূরণ করতে পারবে, অর্থাৎ নির্ধারিত শর্তাবলি পূরণ করতে পারবে- তারাই পিএইচডি ডিগ্রি চালু করতে পারবে।
অনুষ্ঠানে আলোচকের বক্তব্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর জন্য শক্ত নীতিমালা তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি ডিগ্রি পরিচালনার অনুমোদন দেবে, তাদের ‘মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড’ বজায় রাখার জন্য নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন।
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি নীতিমালা: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক
পিএইচডি ডিগ্রি প্রার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রার্থীদের স্নাতক-স্নাতকোত্তার শেষে কতগুলো পাবলিকেশন রয়েছে, সেটি দেখা দরকার। বিভিন্ন কমিটি তার অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও গবেষণার প্রতি আগ্রহ কেমন- তা চেক করতে হবে। এরপর পিএইচডি করার অনুমতি দেবে। পিএইচডি করার আগে বিভিন্ন কোর্স করাতে হবে। রিসার্চ মেথডোলজি, অ্যাকাডেমিক রাইটিং এগুলোতে ভালো করতে হবে। বিভিন্ন ধাপে অ্যাকাডেমিক ফ্রেমওয়ার্কে তাকে টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
নর্থ সাউথ উপাচার্য বলেন, পূর্ণকালীন কাজ করলে একজন গবেষক তার গবেষণায় ফোকাস করতে পারে না। এজন্য পিএইচডি গবেষককে সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে তারা আগ্রহ পাবেন।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম পিএইচডি ডিগ্রির জন্য লাইব্রেরি সুবিধার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষককে পূর্ণকালীন ছুটি নিতে হবে। এছাড়াও যারা পিএইচডি করবেন, তাদেরকে প্রথম বছরেই কিছু পরীক্ষার সম্মুখীন করতে হবে। সেখানে যদি তারা ভালো করেন, তবেই তার পিএইচডি চলমান রাখার অনুমতি দিতে হবে।
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি নীতিমালা: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রব বলেন, নীতিমালার শর্তগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পিএইচডি ডিগ্রির আদলে করা যেতে পারে। কেউ পিএইচডি করতে চাইলে তাকে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হবে এবং ‘ফুল টাইম পিএইচডি’-তে মনযোগ দিতে হবে। তবেই পিএইচডির মান বাড়বে।
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, যারা পিএইচডি প্রার্থীদের কোয়ালিফায়িং টেস্টের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে রিসার্চ মেথডোলজি ও অ্যাকাডেমিক রাইটিংয়ের বিভিন্ন কোর্স রাখা যেতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ থেকে পিএইচডি নিয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি চাকরি নেওয়া সম্ভব? আমাদের মানের দিকে নজর দিতে হবে। নীতিমালা তৈরি বিষয়টি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু নীতিমালায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডির অনুমতি পেল, অন্যটি পেল না। সেক্ষেত্রে অনুমতি না পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় যদি সব শর্ত পূরণ করে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে অনুমতি দেবে- সে বিষয়ে ভাবতে হবে।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. শামস্ রহমান বলেন, পিএইচডি কারা করাবেন, কীভাবে করাবেন, কে করাবেন, প্রসেস কী— এসব অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে। এটি করার ক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য না করা। তিনি বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই পিএইচডি দেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছে। ইউজিসির কাছে অনুরোধ, যত তাড়াতাড়ি এটা চালু করা যাবে, তত ভালো হবে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া বলেন, বাংলাদেশে এখনও পিএইচডির জন্য কোনো পলিসি নেই, এটা থাকা দরকার। এক্ষেত্রে কোয়ালিটির বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। এছাড়াও পিএইচডির জন্য একজন সুপারভাইজার কত জন শিক্ষার্থীকে সুপারভাইজ করতে পারবেন, তার নির্দিষ্ট একটি সংখ্যা থাকা উচিত।
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন বলেন, পিএইচডির মূল্যায়ন কঠোরভাবে করতে হবে। ঢালাওভাবে পিএইচডি না দিয়ে নির্দিষ্ট প্রোগ্রামে দেওয়া উচিত। যে পিএইচডি করবে, তার এটা কোন কাজে লাগবে— সেটাও দেখতে হবে।
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি নীতিমালা: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহফুজুল আজিজ বলেন, পিএইচডি গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। রিসার্চ প্রপোজাল লেখা এবং ডিফেন্স করার প্রক্রিয়া কী হবে এটা নিয়ে ভাবতে হবে। পিএইচডি থিসিস এক্সামিনেশন প্রসেসে ইন্ডিপেনডেন্ট এক্সামিনার বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল এক্সামিনার রাখতে হবে। যে শিক্ষকের গত তিন-চার বছরেও কোনো পাবলিকেশন নেই তাকে সুপারভাইজার হিসেবে রাখা যাবে না। পিএইচডির জন্য একটি প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ট্রেনিং থাকা প্রয়োজন। এছাড়াও একটি রিসার্চ মেথোডলজি কোর্স রাখা উচিত। বাংলাদেশে ন্যাশনাল রিসার্চ কোর অফ এথিকস প্রণয়ন করতে হবে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়টির ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম রিজওয়ান খান বলেন, পিএইচডি দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। যারা ফ্রেশ গবেষণা করে এসেছে তাদের রাখা উচিত সুপারভাইজার হিসেবে।
তিনি বলেন, পিএইচডি করার জন্য ইউনিভার্সিটি বাছাই না করে সুপারভাইজার বাছাই করা উচিত। এছাড়াও পিএইচডিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ক্রাইটেরিয়া রাখা উচিত। পিএইচডি সুপারভাইজারের সাথে একজন কো-সুপারভাইজারও থাকতে পারে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম মাহাবুবুল হক মজুমদার বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যারা অনুকরণীয়, যেমন বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) কিংবা বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা রয়েছে তা অনুসরণ করা প্রয়োজন। ওই নীতিমালা অনুসরণ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি পরিচালনায় অদূর ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা তৈরির সম্ভাবনা থাকবে না।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি) এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে গুণগত মান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অনেক সময় প্রভাবিত করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অনুমোদনের পর সেটির ক্ষেত্রেও এই প্রভাব একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের উচিত সে বিষয়েও সচেতনতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের ডিন অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম. হক বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আগেই পিএইচডি অনুমোদন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে যাদের পিএইচডি প্রোগ্রাম পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে, তাদের অনুমোদন দেওয়া দরকার।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের ডিন অধ্যাপক ড. মো. কবিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গবেষণায় ভালো করছে। কাজেই ইউজিসির পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর যে উদ্যোগ, সেটি নিঃসন্দেহে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সম্পাদক মাহবুব রনি বলেন, দেশে মেধাবীদের অভাব না থাকলেও জ্ঞান তৈরির জায়গার অনেক অভাব। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ জ্ঞান তৈরির ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে। এই পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু হলে সে জ্ঞান তৈরির জায়গা এবং গবেষণার জায়গা প্রসারিত হবে। একইসঙ্গে কোয়ালিটি এডুকেশনের দিকটিও নজরে রাখতে হবে।
গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শামীম মণ্ডলের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য ও পিএইচডি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী।