রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির বিওটি, নিয়ম ভেঙ্গে অব্যাহতি ভিসিকে
- ইরফান এইচ সায়েম
- প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৬ PM , আপডেট: ০২ মে ২০২৪, ০৪:৩৯ PM
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। নিয়ম অনুযায়ী, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগ দেন তিনি। একইসঙ্গে তাদেরকে অপসারণ কিংবা অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্টদের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতিই বিষয়টি করে থাকেন। তবে এ নিয়ম ব্যত্যয়ের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) বিরুদ্ধে। সম্প্রতি নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি।
তবে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হকের দাবি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম ও অর্থ কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় নিয়ম ভেঙে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তিনি চিঠি লিখবেন চ্যান্সেলর বরাবর।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ চার বছরের জন্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন৷ ওইদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়৷ পরে ওই বছরের ১ এপ্রিল বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক ড. মো. নুরুল মোস্তফার কাছে তিনি ভিসি পদের দায়িত্বভার হস্তান্তর করেন। সে হিসেবে আগামী বছরের ১ এপ্রিল তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
প্রায় এক যুগ আগে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ভিসি সাদার্ন ইউনিভার্সিটির বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
আরও পড়ুন: ৫৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেটে বার্ষিক উদ্বৃত্ত ১২৫০ কোটি টাকা
এদিকে, গত ২৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মেম্বার সেক্রেটারি সরওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারারকে ভিসির চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে তাঁর দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি (সাসপেনশন) দেওয়া হয়েছে। গত ২০ এপ্রিলে এই সিদ্ধান্ত সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির নীতি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী ৭৭তম বোর্ড অফ ট্রাস্টির সভায় সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, যা ২১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে।
“অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ থেকে এই ইউনিভার্সিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, শৃঙ্খলা ভঙ্গ, আর্থিক অনিয়ম, অসদাচারণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী কোন এক কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছিলেন। তাঁর বিভিন্ন কার্যক্রম আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে, সকলকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং হুমকি-ধমকির মাধ্যমে এক অপ্রীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। বারবার অনুরোধ করার পরও, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করার হীন উদ্দেশ্যে অবৈধ নিয়োগকৃত রেজিস্ট্রার এর মাধ্যমে ক্রমাগত বিরতিহীনভাবে মিথ্যা অভিযোগ প্রদান, পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করেই চলেছেন দুদকে অভিযোগ ইত্যাদি ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। একটি কারণ দর্শানোর চিঠি ইস্যু করা হয়েছে এবং জবাব প্রাপ্তির সাপেক্ষে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।”
আরও পড়ুন: ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতেই হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়কে সকল কার্যক্রম পূর্বের ন্যায় চলমান রাখতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৩১(৬)অনুযায়ী ট্রেজারারকে ভিসি দপ্তরের সার্বিক কার্যক্রম উপাচার্য (চলিত দায়িত্ব) পালন করার জন্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভায় সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় । সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির বর্তমান অবস্থা আপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে অবহিতকরণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হলো।
এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ বলা হয়েছে, সুষ্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কোন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সুপারিশক্রমে ভিসিকে অপসারণ করতে পারবেন চ্যান্সেলর। তবে শর্ত রয়েছে, অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ভিসিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান করতে হবে। তবে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ভিসি অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনায় এই আইন মানা হয়নি।
জানতে চাইলে অব্যাহতি পাওয়া ভিসি অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ আমাকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে তারা শুধু একটি কাজ করতে পারেন— ভিসি নিয়োগের জন্য শুধু ৩ জনের একটি প্যানেল পাঠাতে পারেন। এর বাইরে আর কিছু পারেন না তারা। আমাকে অব্যাহতি দিতে চাইলে চ্যান্সেলরের আত্মপক্ষের সমর্থনের সুযোগ দিয়ে উনি দিতে পারেন। আর
“চ্যান্সেলর যদি আমার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেন তাহলে আমাকে আত্মপক্ষের সুযোগ দিয়ে আমাকে অপসারণ করতে পারেন। আর কারও কোনো এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার নেই। আর বিওটি অব্যাহতি দিলে সেটা চ্যান্সেলর বরাবর লিখবেন। চ্যান্সেলর যদি মনে করেন এটা গ্রহণযোগ্য অভিযোগ, উনি আমাকে আত্মপক্ষের সুযোগ দিয়ে অপসারণ করতে পারবেন। এখন বিওটি তড়িঘড়ি করে করেছেন, কারণ তারা বাঁচার জন্য।”
আরও পড়ুন: সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জাতীয় র্যাঙ্কিংয়ের সুপারিশ ইউজিসির
তাঁর বিরুদ্ধে উঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বলেন, আগেও এমন অভিযোগ ছিল। কিন্তু কি কি দুর্নীতি করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে কত অবৈধ নিয়োগ দিয়েছি সেটাতো বলতে হবে, সেটার প্রমাণ দেখাতে হবে। এখন উনাদের অভিযোগ, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করছি, তা পেপার-পত্রিকায় তা প্রকাশ হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এরপর থেকে তারা অনেকগুলো জাল সনদ বিক্রি করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় ধরাও পড়েছে। আমি ২০২১ সালে ভিসির দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক দুর্নীতি দেখেছি। যেহেতু এসবের প্রতিকার পাইনি তাই আমি ইউজিসির মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি অবহিত করেছি। পরে তারা যাচাই-বাছাই করতে তদন্ত কমিটি করেছে। এখনতো তারা টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ নাও করতে পারে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে তো বিচার হবে। এ অবস্থা থেকে থেকে তাদের উদ্ধার হওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য তারা আমাকে অব্যাহতি দিয়েছে।
বিওটির সংশ্লিষ্টরা তড়িঘড়ি করে তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন দাবি করে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক আরও বলেন, তারা বাঁচার জন্য এটা করেছেন। অবৈধ সনদ বিক্রির বিরুদ্ধে যদি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে উনারা চিহ্নিত হয়ে যাবেন। এখন আমি চ্যান্সেলর বরাবর লিখবো যে, উনারা এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছেন।
বিষয়টি জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মেম্বার সেক্রেটারি সরওয়ার জাহানের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।