কৌতূহল থেকে এখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার প্রেসিডেন্সির আবুল হাসানাত

ল্যাবে গবেষণায় ব্যস্ত মো. আবুল হাসানাত
ল্যাবে গবেষণায় ব্যস্ত মো. আবুল হাসানাত  © সংগৃহীত

ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। সব সময়ই কৌতূহল হতো, কীভাবে কোনো একটা বিষয় আবিষ্কার হয়। কীভাবে উদ্ভাবক সে তত্ত্ব গবেষণা করেন। প্রযুক্তির প্রতি এ আসক্তিই পুরকৌশল বিদ্যায় অনুপ্রাণিত করে। এ প্রাচীনতম কৌশলবিদ্যা ধীরে ধীরে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য উপশাখায় বিভক্ত হয়ে সভ্যতার অগ্রগতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এভাবে মো. আবুল হাসানাত এখন একজন পুর-প্রকৌশলী বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যার মূল বাহন ছিল প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।

২০১১ সালের ব্যাচ ১১৩। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সাথে পুরকৌশলী হওয়ার স্বপ্নের যাত্রা হাসানাতের। এ যাত্রার মূল অনুপ্রেরণার পেছনে রয়েছে নিরিবিলি ও সবুজে ঘেরা পরিবেশ, এক কথায় ছিমছাম ও সুন্দর ক্যাম্পাস। ইউনিভার্সিটির শিক্ষাশৈলী ছিল অনন্য, পূর্ব-পরিকল্পিত। ক্লাসগুলো ছিল গোছালো ও অত্যন্ত উপভোগ্য, যা দৃঢ় মনোযোগ বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বেশি বিস্ময় হতো, তখন, যখন দেশ সেরা অধ্যাপকগণ পুরকৌশলের অত্যাবশ্যক কোর্সগুলো নিতেন।

আবুল হাসানাত বলেন, কখনো কখনো স্বনামধন্য অতিথি অধ্যাপককে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হতো। স্নাতক ডিগ্রির শেষ অধ্যায় হলো থিসিস, সুপারভাইজার যে কতটা আন্তরিক ও অনুপ্রেরণা দানকারী হতে পারেন, তা নিয়ে বলতে গেলে দিন পেরিয়ে যাবে। এক কথায় ইউনিভার্সিটি কখনোই শিক্ষার জন্য বিন্দু মাত্র ছাড় দেয়নি। ক্লাস প্রতিনিধি হওয়ার দরুন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎ হতো, আজও তাদের আন্তরিক ব্যবহার স্মৃতিতে রয়ে গেছে।

তিনি বলেন, পূর্ব ফলাফলভিত্তিক বেশ ভালো একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম শুরুতেই। আর সাথে কয়েকবার সেমিস্টার ভিত্তিক উপবৃত্তি। এক কথায় প্রেরণাদায়ক এ প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ।

আবুল হাসানাত স্নাতকোত্তর ও গবেষণা শিক্ষাজীবনের পরের অধ্যায় শুরু করেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট)। তার মাস্টার্স ডিগ্রিটি ছিল গবেষণাভিত্তিক। এখানেই গবেষণায় হাতে খড়ি। মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছিল তার গবেষণার বিষয়। যেখানে তিনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. গণেশ চন্দ্র সাহা এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. সিদ্দিকুর রহমানকে যুগ্ন-সুপারভাইজার হিসেবে পেয়েছেন।

তাদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেন গবেষণা বা রিসার্চ প্রক্রিয়া সম্পর্কে। গবেষণার প্রতি আগ্রহ থেকে পিএইচডি করার পরিকল্পনা, প্রস্তুতিও চলতে থাকে। মাস্টার্স শেষ করার পরপরই ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা- প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু আর শেষটা হয়তো এ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কখনো কখনো স্বনামধন্য অতিথি অধ্যাপককে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হতো। স্নাতক ডিগ্রির শেষ অধ্যায় হলো থিসিস, সুপারভাইজার যে কতটা আন্তরিক ও অনুপ্রেরণা দানকারী হতে পারেন, তা নিয়ে বলতে গেলে দিন পেরিয়ে যাবে। এক কথায় ইউনিভার্সিটি কখনোই শিক্ষার জন্য বিন্দু মাত্র ছাড় দেয়নি।

বুয়েটে অধ্যয়নরত অবস্থায় আবুল হাসানাত স্কলারশিপ পেয়েছেন ভারতীয় দুটি শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে। তা হলো- হায়দ্রাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি) এবং আইআইটি রুরকি। তিনি এখন আইআইটি হায়দ্রাবাদের তৃতীয় বর্ষের একজন রিসার্চ স্কলার বা পিএইচডি ক্যান্ডিডেট। তার দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ল্যাবগুলোতে। এখানে তার রিসার্চ এরিয়া ‘biotreatment, biorefinery, renewable energy, এবং industrial wastewater.’

অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণা
প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ফাইনাল থিসিস ডিফেন্স’র আগেই আবুল হাসানাত কাজ করার সুযোগ পান ঢাকা ওয়াসার একটি ডিজাইন প্রজেক্টে, পদ ছিল জুনিয়র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মাত্র এক বছর পর যোগদান করেন একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন প্রভাষক, স্বপ্ন যেন সত্যি হওয়ার মতো অবস্থা। কয়েক বছরে এ ইউনিভার্সিটি শিক্ষকতার পেশায় পুরকৌশলের বেশ কিছু কোর্স পড়িয়েছেন। করিয়েছেন প্রায় ২০টি থিসিস সুপারভিশন।

এ ছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী পরিচালিত উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও কয়ে কবছর কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিটি চাকরি তার জন্য এক একটি শিক্ষণীয় সুযোগ নিয়ে এসেছে, অনেক কিছু শিখেছি আমার এ ছোট্ট অভিজ্ঞতা থেকে। যতই শিখছি বুঝতে পারছি, আরো কতটা শেখ বাকি।

আরো পড়ুন: সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অদম্য মেধাবী তামান্না এবার পড়বে আর্মেনিয়ায়

নতুনদের জন্য পরামর্শ
বর্তমানে যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন তাদের জন্য কিছু নির্দেশনা আছে আবুল হাসানাতের। তিনি বলেন, ভবিষ্যত পেশা যেটাই হোক না কেন, ছাত্রাবস্থায় আমাদের কাজ একটাই, সেটা হলো- প্রতিটা কনসেপ্ট বা তত্ত্ব পুরোপুরি শেখা এবং পর্যালোচনা করা। আমরা অনেক সময়ই শুধু একটা ভালো সিজিপিএ বা ন্যূনতম ফলাফল অর্জন করতে চাই ডিগ্রি জন্য। আমি মনে করি- এরকম চিন্তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক।

দ্বিতীয়ত, আপনাদের প্রকৌশলী হবার যাত্রায় হয়তো অনেক প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, এখানে আপনাকে আপনার সক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে, দিতে হবে নিজের থেকে সর্বোচ্চটি। ধরুন আপনার কাছে কলম না থাকলে, পড়া বন্ধ করে না দিয়ে পেন্সিল দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো। লেখাপড়া ব্যতিরেকে কোনোকিছুতেই কালক্ষেপন করা উচিত হবে না।

তিনি আরো বলেন, আমরা শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বিভ্রান্তিতে ভুগি, সংকোচ বোধ করি প্রশ্ন করতে। এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করবেন। আর আপনারা যারা পুরকৌশলে আছেন, তারা এর ব্যবহারিক গুরুত্ব সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করবেন এবং নিজেকে গড়ে তুলবেন। পুর-প্রকৌশলী নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে- একজন ডাক্তার অপারেশন ভুল করলে একজন রোগীর মৃত্যু হতে পারে, আর একজন প্রকৌশলীর ভুল করলে কয়েকজন বা অগণিত। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অনেক পুরোনো একটা শাখা হলেও এর চাহিদা কখনোই পুরোনো হবার নয়।

আবুল হাসানাত বলেন, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি থেকেই আমার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হাতেখড়ি। আমার কাছে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান অপরিসীম। চেষ্টা করেছি আমার ক্যারিয়ারে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ও তার সাথে নতুনদের জন্য কিছু নির্দেশনা তুলে ধরতে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের সবার মঙ্গল কামনা করেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ