আওয়ামী লীগ নেতা থেকে ‘ফেনীর গডফাদার’, বিতর্কিত এক জীবন

জয়নাল আবদীন হাজারী
জয়নাল আবদীন হাজারী  © ফাইল ছবি

বিতর্কিত এক জীবন। ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক নির্বাসন, দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া, ফের কোর্টে আত্মসমর্পণ করে সাজা ভোগ, আগাম জামিন, পত্রিকার সম্পাদক, আবার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হওয়া— বৈচিত্র্যে ভরপুর আর উত্থান-পতনের সাতকাহন। তিনি জয়নাল আবদীন হাজারী। জয়নাল হাজারী নামে যাকে চেনে সবাই।

জয়নাল হাজারী

৭৮ বছর বয়সে বির্তকিত এই রাজনীতিবিদ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এক সময় ফেনী জেলায় তার কথাই ছিল আইন। তার অঙ্গুলি হেলনে চলত ফেনীর রাজনীতি, জীবনযাত্রা। জাতীয় গণমাধ্যমে তাই তিনি সংবাদ শিরোনাম হতেন প্রায়ই, যার বেশির ভাগ ছিল নেতিবাচক সংবাদ। ফলে সারা দেশে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘ফেনীর গডফাদার’ নামে। 

ফেনীতে তার ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি’ নামের এক ‘সরকার ছিল সেখানকার বিভীষিকার নাম। এই কমিটির মাধ্যমে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো ফেনী শহর। নেতাকর্মী-ক্যাডার পরিবেশিষ্ট হয়ে চলা একসময়ের প্রভাবশালী এই মানুষটি শেষ বয়সে ছিলেন বিরলে-নিভৃতে। সঙ্গী নিজের সম্পাদিত দৈনিক পত্রিকা ‘হাজারিকা প্রতিদিন’।

১৯৪৫ সালের ২৪ আগস্ট সাহদেবপুরে তারা নানা হাবিবুল্লাহ পণ্ডিতের বাড়িতে তার জন্ম। অনেক সাধনার পর পুত্র সন্তানের মুখ দেখে বাবা গণি হাজারী খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন । কে জানতো এই শিশুই একদিন হয়ে উঠবেন ফেনীর ডন। তিনি ছিলেন তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী রিজিয়া বেগমের প্রথম সন্তান।

ফাইল ফটো

১৯৬৩ সালে ফেনী হাই স্কুল (বর্তমানে ফেনী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন হাজারী। ফেনী কলেজে ভর্তি হবার পর শুরু হল তার জীবনের নতুন অধ্যায়। কলেজ ছাত্রলীগের যোগ দেয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হন। পরবর্তীতে জেলা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করা স্থানীয় পর্যায়ে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে ফেনীর জয়নাল হাজারী অন্যতম।

১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আলোচিত এই রাজনীতিবিদ। এই সময়ে ফেনী-২ (সদর) আসন থেকে ১৯৮৬ সালের তৃতীয়, ১৯৯১ সালের পঞ্চম এবং ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে যে কয়জন সংসদ সদস্য নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচিত ছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন জয়নাল হাজারী। কিন্তু তার এই ‘লড়াই’ এরপর আর বেশি দিন টেকেনি।

২০০১ সালের ১৭ আগস্ট তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশ ছেড়ে পালান জয়নাল হাজারী। ওই দিন গভীর রাতে কার্ফু জারি করে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে তল্লাশি চালানো হয় তার বাড়িতে। কিন্তু তার আগে পালান জয়নাল হাজারী।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এরই মধ্যে পাঁচটি মামলায় ৬০ বছরের সাজা হয় তার। এরপর ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করলে হাজারী আট সপ্তাহের জামিন পান। পরে ১৫ এপ্রিল নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে পাঠানো হয় কারাগারে। প্রায় চার মাস কারাভোগের পরে ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর মুক্ত হন তিনি।

কিন্তু ততোদিনে ফেনীর সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যায় জয়নাল হাজারীর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দীর্ঘদিন বিদেশে পালিয়ে থাকার সময় ফেনীর রাজনীতিতে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি কমে যায় অনেকটা। দীর্ঘদিন পরে দেশে এলেও তা আর পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। রাজনীতিতেও তেমন সক্রিয় দেখা যায়নি তাকে। বেশির ভাগ সময় অবস্থান করেন ঢাকায়। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তারই একসময়ের অনুসারী নিজাম উদ্দিন হাজারী।

জীবনের শেষ দিকে এসে হাজারিকা সম্পাদনা ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সব সময়ই সক্রিয় ছিলেন এই রাজনীতিক। ফেসবুক লাইভে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বক্তব্য দেন তিনি। সেখানে ফেনীর রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও কথা বলতেন। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করা হয়েছিল আলোচিত সাবেক এই সংসদ সদস্যকে।


সর্বশেষ সংবাদ