১৫ বছর ধরে পাখির প্রতি এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

করোনার মধ্যে পাখির প্রতি এই ভালোবাসা বন্ধ হয়নি
করোনার মধ্যে পাখির প্রতি এই ভালোবাসা বন্ধ হয়নি  © টিডিসি ফটো

ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা সম্ভব। কারণ ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে এক অমোঘ শক্তি। এই অনন্য শক্তিতে ভর করে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে রচিত হতে পারে অনন্য বন্ধন। ভালোবাসার এমনি এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার দুই সাধারণ দোকানি। তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বুনো পাখিরাও ভয়কে উপেক্ষা করে ছুটে আসছেন মানুষের কাছাকাছি। বলছিলাম স্থানীয় চা দোকানদার ইছাহক আলী ও হোটেল মালিক আনন্দ দেবনাথের কথা।

১৫ বছর ধরে অসংখ্য শালিক পাখিকে খাইয়ে আসছেন তারা। এই করোনা মহামারির কারেণ দেশে যেখানে প্রচণ্ড আকাল চলছে সেই সংকটকালেও এই দুই পাখিপ্রেমীর পাখিদের খাবার দেয়া একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। খাবারের জন্য প্রতিদিন শত শত শালিক পাখি মিরপুর পৌর শহরের ব্যস্ততম ঈগল চত্বরে ছুটে আসে। সেখানে মিতালী হয় মানুষ আর বুনো পাখির।

সরেজমিন যায়, ভোরের আলো ফোটার তখনো কিছুটা বাকি। মিরপুর পৌর শহরের ব্যস্ততম ঈগল চত্বরে উড়ে আসছে শত শত শালিক পাখি। বৈদ্যুতিক লাইনের তার বা দোকান ঘরের কার্নিশে সারি বেঁধে বসছে তারা। ধীরে ধীরে ঈগল চত্বরে দোকানিসহ নানা শ্রেণির মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে।

ঈগল চত্বর চিরে যাওয়া রাজপথও ব্যস্ত হয়ে উঠে যানবাহনের চাপে। এরই মধ্যে চা দোকানি ইছাহক আলী ও হোটেল মালিক আনন্দ দেবনাথ মুঠো মুঠো চানাচুর আর পরোটার টুকরো ছড়িয়ে দেন ব্যস্ত রাজপথে। মুহূর্তেই বিদ্যুতের তার আর দোকানের কার্নিশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক উড়ে এসে মহাভোজে যোগ দেয় মনের আনন্দে। এরই মাঝে থেকে থেকে ছুটে চলেছে বিভিন্ন যানবাহন। তবুও শালিকের ঝাঁক নির্ভয়ে খেয়ে চলেছে।

মানুষের গলার শব্দ শুনলেই যে পাখিরা প্রাণ ভয়ে পালায় সেই পাখিরাই এখানে মানুষের সাথে মিলে মিশে যেন একাকার। এক পর্যায়ে ইছাহক আলী চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে দোকানে ঢুকে পড়েন, তখন পাখিগুলোও তার পিছু নেয়। গত ১৫ বছর ধরে এই দুই দোকানি এভাবেই খাবার খাইয়ে পাখিগুলোর বন্ধু হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন ভোরে এমন এক নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ করেন ঈগল চত্বরের দোকানি আর পথচারীরা।

এ বিষয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করে চা দোকানি ইছাহক আলী বলেন, ভোরবেলা সবার আগে দোকান খুলে দুধ গরম করা পাত্রে লেগে থাকা দুধের পোড়া অংশ চেঁছে তুলে রাস্তায় ছড়িয়ে দিতাম। তখন দু-একটি শালিক পাখি এসে সেগুলো খেয়ে যেত। রোজ সকালেই এমনটি ঘটত। দিন যত গড়ায় শালিকের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে। তখন শালিকগুলোর প্রতি এক ধরনের টান তৈরি হয় আমার। এরপর প্রতিদিন বড় সাইজের এক প্যাকেট চানাচুর বরাদ্দ করলাম ওদের জন্য। এখন তো শত শত শালিক আসে খাবার খেতে। দুটো পয়সা খরচ হলেও ওদের কলতানে যে কি আনন্দ পাই তা বলে বুঝাতে পারব না।

ইছাহকের দোকানের পাশে আনন্দ দেবনাথের খাবার হোটেল। দিন শেষে কিছু না কিছু খাবার বেঁচে যায়। ইছাহকের দেখাদেখি আনন্দ দেবনাথও শালিকের ভালোবাসায় মজেছেন। তিনিও রোজ শালিকদের ভোজে খাবারের যোগান দেন নিয়মিত।

আনন্দ দেবনাথ বলেন, ওদের তো বাঁচিয়ে রাখা দরকার। ওরা তো আমাদের ক্ষতি করে না বরং উপকার করে।

স্থানীয়রা বলছেন, ভালোবাসার বিনিময়ে যে অনেক কিছু জয় করা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন ইছাহক আর আনন্দ দেবনাথ। ভালোবাসার বিনিময়ে পাখির সাথে তারা দুজন সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এভাবে পাখিদের পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে তারা জানান।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, শালিক ফসলবান্ধব পাখি। বিশেষ করে আমন মৌসুমে তারা ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এতে কৃষকদের কীটনাশক খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এই কারণে শালিক পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার।

তিনি বলেন, শালিক পাখিদের খাবার খাইয়ে মিরপুরের দুই দোকানি একদিকে যেমন মহান কাজ করছেন, তেমনি পাখিদের প্রতি সহানুভুতিশীল হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন।


সর্বশেষ সংবাদ