বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে ভোটগ্রহণ শুরু, জানুন চমকপ্রদ পরিসংখ্যান

খচ্চরের পিঠে ভোটের সরঞ্জাম চাপিয়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন ভোটকর্মীরা
খচ্চরের পিঠে ভোটের সরঞ্জাম চাপিয়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন ভোটকর্মীরা  © বিবিসি বাংলা

ভারতের নাগরিকরা পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দেশটির সংসদ সদস্যদের নির্বাচন করতে শুরু করেছেন। এ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য ভোটে লড়ছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপে তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আর তার জোট সঙ্গীদের এগিয়ে রেখেছে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিপরীতে লড়াই করছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। কংগ্রেসসহ দু’ডজনেরও বেশি বিরোধী দল এ জোটে রয়েছে।

সংসদের নিম্ন কক্ষ লোকসভার সদস্যদের বেছে নেওয়ার এ নির্বাচন হচ্ছে তিক্ত পরিবেশের মধ্যে। বিরোধীরা অভিযোগ করছে, তারা পক্ষপাতিত্বের শিকার হচ্ছে। কারণ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি অনেক বিরোধী নেতাদের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। কংগ্রেস বলছে, ছয় সপ্তাহ ধরে আয়কর বিভাগ তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে রেখেছে, যার ফলে নির্বাচনী প্রচারণার খরচ চালাতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

আবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। সব দুর্নীতির অভিযোগ অবশ্য তারা সবাই অস্বীকার করছেন। বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনকে হস্তক্ষেপ করার জন্য আবেদন করেছিল। কমিশনও আবার তাদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা সব দল এবং প্রার্থীদের সমান নজরে দেখছে, পক্ষপাতিত্ব করছে না।

চমকপ্রদ পরিসংখ্যান
প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত বিশ্বের সবথেকে জনবহুল দেশ। এরকম একটা দেশে নির্বাচন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যেতে পারে।লোকসভার ৫৪৩ জন সদস্যকে নির্বাচন করতে ছয় সপ্তাহ ধরে সাত দফায় ভোট নেওয়া হবে। ফলাফল প্রকাশিত হবে ৪ জুন। এ নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৬ কোটি ৯০ লাখ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল আর ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় সমসংখ্যক মানুষ ভারতের নির্বাচনের ভোটার তালিকায় রয়েছেন।

ওই সব দেশগুলোর মিলিত জনসংখ্যা ভারতের ভোটারের সংখ্যার থেকে সামান্য কম। তাই ওই দেশগুলোর সঙ্গে বেলজিয়ামের জনসংখ্যাও জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। এবারের ভোটারদের মধ্যে ৪৯ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৪৭ কোটি ১০ লাখ নারী। প্রথমবার ভোট দেবেন, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮-১৯ বছর, এমন ভোটার এক কোটি ৮০ লাখ। প্রবীণ ভোটার, যাদের বয়স ৮৫ থেকে ৯৯ বছর, এরকম ৮২ লাখ মানুষের নাম আছে ভোটার তালিকায়।

নিরাপত্তা আর ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণেই নানা দফায় ভোট করানো হচ্ছে। বয়স্ক আর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের, তাদের বাড়িতে গিয়েও ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারের কথায়, ভারতের প্রতিটি কোনায় গণতন্ত্রকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য’ ১৫ লাখ ভোট কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। একজন ভোটার জঙ্গলে বাস করুন অথবা তুষারাবৃত পাহাড়ে, কর্মীরা বাড়তি পরিশ্রম করে হলেও প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছাবেন। 

বেশিরভাগ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রই স্কুল, কলেজ বা কমিনিউটি সেন্টারে হলেও বেশ কিছু অদ্ভুত জায়গাও বাছা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাহাজের কন্টেইনার, পাহাড়ের চূড়া বা জঙ্গলের মধ্যেও বুথ হচ্ছে।

রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হল উত্তরপ্রদেশ। সে রাজ্যে ভোটার রয়েছেন প্রায় ২৪ কোটি। এটিই ভারতের সবথেকে জনবহুল রাজ্য। আর এখান থেকেই সংসদে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হন। বিশ্লেষকরা বলেন, দিল্লি যাওয়ার পথটা উত্তর প্রদেশ হয়েই যায়। এ রাজ্যে যে দল ভালো ফল করে, সাধারণত: ভারত শাসন করে তারাই। এ রাজ্য থেকে ভারতের আটজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন, সে বছর বিজেপি উত্তরপ্রদেশের ৮০টির মধ্যে ৭১ টি আসনে জিতেছিল। পরের বার, ২০১৯ সালে অবশ্য বিজেপির জেতা আসনের সংখ্যাটা কমে ৬২ হয়েছিল। মোদী ২০১৯ সালে প্রাচীন শহর বারাণসী আসন থেকে জিতেছিলেন, এবারও তিনি ওই আসন থেকেই ভোটে লড়ছেন। উত্তর প্রদেশ থেকে যেমন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, অন্যদিকে রয়েছে সিকিম, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম আর আন্দামান, লাক্ষাদ্বীপ এবং লাদাখের মতো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলি, যার প্রতিটি থেকে মাত্র একজন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

অন্য যেসব রাজ্য এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে ৪২টি আসনের পশ্চিমবঙ্গ, ৪৮টি আসনের মহারাষ্ট্র, ৪০ আসনের বিহার এবং ৩৯টি আসনের তামিলনাডু। দেশের ২২টি রাজ্য আর কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে একদিনেই ভোট নেওয়া হয়ে যাবে। তবে উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারের মতো বড় রাজ্যগুলোতে সাত দফায় ভোটগ্রহণ হবে।

বিজেপি, কংগ্রেস,আম আদমি পার্টি আর সিপিআইএম সহ ছয়টি জাতীয় স্তরের স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ছাড়াও আরও কয়েক হাজার প্রার্থী এই নির্বাচনে লড়তে চলেছেন। জাতীয় দলগুলো ছাড়াও ৫৮টি আঞ্চলিক ভাবে স্বীকৃত দল এবং আরও অনেক ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাও ভোটের ময়দানে নেমেছেন। তবে সবার নজর থাকবে হেভিওয়েট প্রার্থীদের দিকে। প্রথমেই নাম করতে হয় নরেন্দ্র মোদীর।

তিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। জনমত সমীক্ষাগুলি জানাচ্ছে তিনিই সম্ভবত ফিরে আসতে চলেছেন। যদি ৭৩ বছর বয়সী মোদী এবারও জিততে পারেন, তাহলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবেন। মোদীর বড় সমর্থক গোষ্ঠী আছেন, যারা মনে করেন তিনি সুশাসন দিতে পেরেছেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ‘মাথা উঁচু’ করেছেন।

তার সমালোচকরা বলেন, পেশীশক্তির প্রদর্শন করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যে রাজনীতি তিনি করেন, সেখানে সংখ্যালঘুদের কোনও জায়গা নেই। আর তিনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ যে ভাবমূর্তি ছিল, সেটাও নষ্ট করে দিচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদী যেভাবে ধর্ম আর ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করেন, তা খুবই কার্যকরী হয়। কারণ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

এ বছরের নির্বাচনে তার প্রধান স্লোগান হয়ে উঠেছে, ‘এবার চারশো পার’, অর্থ তার দল ৪০০টি আসন জেতার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে সংসদের নিম্ন কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাদের প্রয়োজন ২৭২টি আসন। গত নির্বাচনে, দলটি ৩০৩ টি আসনে জয়ী হয়েছিল।

রাহুল গান্ধী কখনও মন্ত্রী হননি, কিন্তু সবচেয়ে পরিচিত বিরোধী নেতা তিনি। তার রাজনৈতিক পরিচয়ের অনেকটাই বংশ পরম্পরায় পাওয়া – দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে তার ঠাকুমা এবং বাবা দুজনেই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিগত এক দশকে বিজেপির যত উত্থান হয়েছে, গান্ধীর দল কংগ্রেস ততই ক্ষীণ হয়েছে। তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়ার দিকে সমালোচকরা তাকে ‘অনিচ্ছুক রাজপুত্র’ বলে আখ্যা দিত। সে আখ্যা ঘোচাতে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপী দুটি পদযাত্রা, যার মাধ্যমে তিনি ‘হিংসা ও দ্বেষের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ’ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। জনমত সমীক্ষায় অবশ্য কংগ্রেসকে বিজেপির অনেক পেছনে ফেলেছে।

আরো পড়ুন: তীব্র তাপপ্রবাহের জেরে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল ছুটি ঘোষণা

এক দশক আগে যখন কংগ্রেস শেষবার সরকারে আসীন ছিল, তখন তার মা সোনিয়া গান্ধীকে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী বলে মনে করা হতো। তবে গত কয়েক বছরে ৭৭ বছর বয়সী গান্ধীর যেমন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়েছেন, তেমনই রাজনীতিতে তার প্রভাবও কমেছে। এ বছর জানুয়ারি মাসে তিনি সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন, তাই লোকসভা নির্বাচনে তিনি লড়াই করছেন না।

গান্ধী পরিবারের আরও একটি নাম প্রতি নির্বাচনের আগেই আলোচনায় উঠে আসে। তিনি হলেন তার কন্যা প্রিয়াঙ্কা। যদিও তিনি কখনও লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হননি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মতোই অনেকটা দেখতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনী প্রচার চালান। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কারণে প্রশংসিতও হন। এবারও তার সমর্থকদের মধ্যে থেকেই দাবি উঠেছিল, তিনি যেন নির্বাচনে দাঁড়ান।

বিরোধী নেতাদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি এখন অবশ্য গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ