মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ ও নির্বাচন ব্যবস্থা
- সাইদুর রহমান
- প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১৪ PM , আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪৮ PM
দীর্ঘ ২৩ বছরের দমন-পীড়িন ও নির্যাতনের পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলই স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করেছিলো। নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় নির্যাতক পাকিস্তানি শাষক গোষ্ঠির দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিরীহ বাঙ্গালী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলো। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের আমলে ১৯৭০ সালে প্রথম পাকিস্তানের নির্বাচন হয়। জাতীয় পরিষদের এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলো তৎকালীন শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিপুল জনমতকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে দেয়নি ফ্যাসিষ্ট শাসকরা। পরবর্তীতে জনমত উপেক্ষার চরম খেসারত দিতে হয় পাকিস্তানকে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করে কর্তৃত্ববাদ ও দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও তিন লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা। পাকিস্তানিদের সীমাহীন অনাচারের বিরুদ্ধে যে মহান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে এ দেশের আপামর জনতা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলো, পরবর্তীতে কার্যত সেটির বিচ্যুতি ঘটেছে। যে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিষ্ট কর্তৃক নির্যাতিত ছিলো, সেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে বড় ফ্যাসিষ্ট হয়ে উঠেছিলো।
বাংলাদেশ সৃষ্টির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের প্রথমটি হলো বাংলাদেশ হবে জনগণের দেশ এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত দেশ; অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত দেশ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ হবে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত, অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত; অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক দেশ। বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্র; কিন্তু বাস্তবে শাসনকার্যে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক বাংলাদেশ। বিগত সময়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি ও দুর্নীতির ক্রমবিকাশ এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও আলোচিত ও সমালোচিত।
স্বাধীন বাংলাদেশে কার্যত নির্বাচন ছিলো নির্বাসিত। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদের ৭টি নির্বাচনই বিতর্কিত। এগুলো হলো ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ, ১৯৮৬ সালের ৭মে ক্ষমতা দখলের নির্বাচন, ১৯৮৮ সালের ৩রা মার্চ একতরফা নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়মরক্ষার নির্বাচন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতে ভোট এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দেশে ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। তবে ১৯৭৯ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়েও কিছুটা বিতর্ক আছে।
বিগত ১৫ বছর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোও হয়েছে একতরফা। বাংলাদেশের নির্বাচনের বিগত সব নেতিবাচক রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। ১৫৩ আসনে বিনাভোটে এমপি, ইউপি নির্বাচনে শত শত প্রাণহানি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার হিড়িক পড়ে। সিটি করপোরেশন, ইউপি, জেলা পরিষদ, পৌরসভা কিংবা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনও ছিলো অনেকটা একতরফা। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন মানে বিজয়ী হওয়ার রীতি চালু হয়। নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় প্রভাব বিস্তার করে পুলিশ-প্রশাসন ও ভোটগ্রহন কর্মকর্তাদের একাংশ ক্ষমতাসীনদের অংশীদারে পরিণত হয়। নির্বাচন ব্যবস্থায় ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার ফলে কিছু অযোগ্য এবং অশিক্ষিত, লোভী ক্ষমতাধররা চলে আসেন সামনের দৃশ্যপটে। ফলে সুশাসনের দারুন ঘাটতি দেখা দেয়। সুশাসন ও জবাবদিহিতা ছিলো না। লুটপাট-দুর্নীতি বেড়ে যায়। মেগা মেগা প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতির মহোৎসব চলে। বাংলাদেশের জনগনকে ভোটের নামে অন্ধকারে রেখে বিগত ১৫ বছর শাসন করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস সুখকর নয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এখনো পরিপূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অগ্রসর হতে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংবিধানে ১১৮ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। ১২৩ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের একটি সাধারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা আছে।
বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ: ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর নয় মাস ব্যাপী সংগঠিত হওয়া রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কালে দেশের ধন-সম্পদ ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পরে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক ছিল। সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন গঠন ছিল সরকারের জন্য প্রধান অগ্রাধিকারমূলক কর্তব্য। এছাড়া একটি প্রাদেশিক সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নীত করার কাজ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ছয় দিন পরে ২২শে ডিসেম্বর, ভারতের কলকাতা থেকে সক্রিয় মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রী এম মনসুর আলী, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনী ওসমানী কলকাতা থেকে বিশেষ বিমান যোগে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৭ই এপ্রিল তারিখে মেহেরপুরে মুজিবনগর সরকার গঠন করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলকাতার থিয়েটার রোড সড়কের একটি ভবন থেকে তাদের কার্যাবলী পরিচালনা করেছিলেন।
দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে মুজিবনগর সরকার বেশ কিছু নির্দেশ প্রদান করেন, যার মধ্যে একটি ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লিগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং নিজাম-ই-ইসলাম পার্টি এই চারটি সাম্প্রদায়িক দলকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধকরণ। ২৩শে ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ সচিবালয়ে সরকারী কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রশাসন কীভাবে কাজ করবে, তার নির্দেশনা প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনিই ছিলেন তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিলি¬ হয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবেই শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। ১২ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। এর আগে ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার বৈঠকে সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্তের পর শেখ মুজিবুর রহমান কিছু সাংবিধানিক নির্দেশ জারি করেন এবং সে অনুযায়ী সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের বর্তমান রুপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারীভাবে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি, নবগঠিত মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে ১৯০৫ সালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত আমার সোনার বাংলা গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রত্যাহর করা হয়। ১৯৭২ এর ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয় সেই সময় দেশটির সাংবিধানিক নাম দেয়া হয় "বাংলাদেশ"। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয়। ১৯৭৩ সালের মার্চে প্রথম জাতীয় নির্বাচনের পথে অগ্রসর হয় মুজিব সরকার।
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো মাত্র ১৫টি রাজনৈতিক দল। সে সময় ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হলেও ১৫টি আসন সংরক্ষিত ছিল নারীদের জন্য। সে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তখন ব্যাপক বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিলো। কুমিল্লা থেকে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে বিজয়ী করার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ব্যালট এনে গণনা করা হয়। মোশতাককে বিজয়ী ঘোষণা নিয়ে বিতর্র্ক তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করেছিল। বিরোধী দলগুলোর আরো ২০ থেকে ২৫টি আসনে জয়লাভ করার কথা থাকলেও তাদেরকে জোরপূর্বক হারিয়ে দেয়া হয়। নির্বাচনে স্বতন্ত্র ৫জন, জাতীয় লীগ ও জাসদ থেকে ১টি করে আসন জয়লাভ করে। সে নির্বাচনে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৫ হাজার ৬৪২ জন ভোটার ছিলেন। নির্বাচনে ভোট পড়েছিলো ৫৫ শতাংশ। নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, দেশে কোন বিরোধী দল নেই। এই সংসদের মেয়াদ ছিলো ১৯৭৩ সালের ৭এপ্রিল থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীবলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্বতি পরিবর্তন করে একদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টি এবং জাতীয় লীগ নিয়ে এই বাকশাল রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম কিংস পার্টি বলা হয় এই বাকশালকে। ১৯৭৮ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তন করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জনক বলা হয় স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলাম আবার রাজনীতিতে ফেরে।
দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন: প্রথম সংসদ নির্বাচনের প্রায় ৮ বছর পর দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ওই নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ৩০টি। নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯টি, জাতীয় লীগ দুটি, আওয়ামী লীগ (মিজান) দুটি, জাসদ আটটি, মুসলিম ও ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি এবং বাংলাদেশ গণফ্রন্ট দুটি আসন পায়। এছাড়া ন্যাপ, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দল ও জাতীয় একতা পার্টি একটি করে আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয়লাভ করে। মোট ৩০টি রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রথমে অংশ নিতে রাজি না থাকলেও শেষ মুহূর্তে তারা নির্বাচনে এসেছিল। রাজেনৈতিক পর্যবেক্ষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার 'বিএনপি সময়-অসময়' বইতে লিখেছেন, দ্বিতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা সংসদে জায়গা পান। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক বিপদগামী সেনা হত্যাকান্ডে শহীদ হন জিয়াউর রহমান। তখন সেনা প্রধান ছিলেন এইচ এম এরশাদ। এমন পরিস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর দেশব্যাপী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন বিচারপতি সাত্তার। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের জায়গায় সামরিক আইন জারির মাধ্যমে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন এইচ এম এরশাদ।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন: তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ৭ই মে। এই সংসদের মেয়াদকাল ছিল মাত্র দেড়বছর। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সে নির্বাচন বর্জন করলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তাতে অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো জামায়াতে ইসলামীও। নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগে এইচএম এরশাদ ও শেখ হাসিনার লং ড্রাইভ রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত। ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে জয়লাভ করেছিল। এছাড়া আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল ৭৬টি আসনে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি পাঁচটি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) তিনটি, জাসদ (রব) চারটি, জাসদ (সিরাজ) তিনটি, জামায়াতে ইসলামী ১০টি, মুসলিম লীগ চারটি, ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩২টি আসনে জয়লাভ করে। সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা। মওদুদ আহমদের বর্ণনায় ব্যাপক সন্ত্রাস ও কারচুপির মধ্য দিয়ে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক এলাকায় ভোটাররা হয় ভোটদানে নিরুৎসাহিত ছিলেন কিংবা তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য নির্বাচন কেন্দ্রে যেতেই দেয়া হয়নি। সে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির কারণে তার দল জয়লাভ করতে পারেনি। কিন্তু তারপরেও শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর ভূমিকা নেন এবং সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করে তখন পরিস্থিতি নিজের অনুক‚লে রাখার জন্য তিনি সংসদ ভেঙ্গে দেন। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙ্গে দেবার ৯০ দিনের মধ্যে নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা বাধ্যতামূলক। সেই হিসাবে ১৯৮৮ সালের ৩রা মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর সাত মাস। বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে মাত্র ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। সে নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫২টি আসনে জয়লাভ করে। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন মওদুদ আহমদ। অন্যদিকে বিভিন্ন ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি আসনে জয়লাভ করে। বিরোধী দলীয় নেতা হন জাসদের আ স ম আব্দুর রব। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৫টি আসনে, জাসদ (সিরাজ) তিনটি ও ফ্রিডম পার্টি দুটি আসনে জয়লাভ করে। কোন প্রতিযোগিতা না থাকায় মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তেমন ছিলনা এবং সারাদেশে ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। বিদেশি সংবাদমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষকদের মতে ভোট পড়েছিল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। সংরক্ষিত নারী আসন সংক্রান্ত আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই সংসদে মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩০০টি।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বিএনপির নেতৃত্বে সর্বদলীয় তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের পতন হয়। গণআন্দোলনে এরশাদের বিদায়ের পর তখনকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থায় নতুন ধারায় প্রবেশ করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সে নির্বাচন ছিল নানা কারণে ভিন্নমাত্রার। নির্বাচনে ১৪০টি আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৮টি আসন, জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন। এছাড়া আরো কয়েকটি দল কয়েকটি আসনে জয়লাভ করেছিল। জামায়াতে ইসলামীর সহায়তা নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। প্রথমবারের মতো সংসদ নেতা নির্বাচিত হন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হন। বিরোধী দলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। এছাড়া নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ৩০ জন নারী সাংসদ নির্বাচিত হন।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের জন্য একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ধারণা নিয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ-জামায়াত যৌথভাবে আন্দোলনে নামে। মাগুরার উপ-নির্বাচনে কারচুপিকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ধারণা সামনে চলে আসে। ১৯৯৪ সালের ২রা ডিসেম্বরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি-জাপা এবং জামায়াতে ইসলামীর ১৪৮ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করে আন্দোলনে নামেন। ওই বছরের ২৭শ মার্চ সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগ-জামায়াত-জাপার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রুপরেখা ঘোষণা করা হয়। ১৪৮ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলেও তৎকালীন স্পিকার আব্দুর রাজ্জাক তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে সংসদে ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত দেখিয়ে ১৯৯৫ সালের ৩১শে জুলাই আসনগুলো শূণ্য ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ওই আসনগুলোতে উপ-নির্বাচন আয়োজন উদ্যোগ নিলে বিরোধী দলগুলো তা বর্জন করে। আন্দোলন দেশ অচল করে দেয়। ১৯৯৫ সালের ২৪ শে নভেম্বর ৫ম জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্যে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এই নির্বাচনটি ছিলো মুলত নিয়মরক্ষার নির্বাচন। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাযুক্ত করার নির্বাচন। ৪১টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি ২৭৮টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। এর মধ্যে ৪৯টি আসনে বিএনপি প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টি একটি আসন পায়। বাকি ১০ আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এছাড়া ১০টি আসনে ফলাফল অসমাপ্ত ছিল এবং একটি আসনের নির্বাচন আদালতের আদেশে স্থগিত করা হয়। এ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২৬.৫৪ শতাংশ। এ সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৪.৯৬ শতাংশ। ৮১ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অন্য দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি, জামায়াতে ইসলামী তিনটি, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাসদ একটি করে আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন একটি আসনে। সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ২১ বছর পরে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা সংসদ নেতা হন এবং বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
অষ্টম সংসদ নির্বাচন: ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। ৫৪টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি বাদে অন্য দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ৬২টি, জামায়াতে ইসলামী ১৭টি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৪টি, জাতীয় পার্টি (না-ফি) চারটি, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) একটি, ইসলামিক ঐক্যজোট দুটি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ একটি আসন পায়। বাকি ছয় আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৫.৫৯ শতাংশ। জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। সংসদ নেতা হন খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন করা হয় ৫০টি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন সরকারের মেয়াদ শেষ হয়। পল্টনে লগি-বৈঠা নিয়ে আক্রমন চালিয়ে ১১জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। ওই সময়ে নিয়মানুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা ছিলো আপিল বিভাগের সর্র্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কেএম হাসানের। বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে সংবিধান সংশোধন ইস্যুকে সামনে এনে আওয়ামী লীগ কেএম হাসানকে নিয়ে তীব্র আপত্তি জানান। দলটির অভিযোগ ছিলো কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে এই সংশোধনী এবং তিনি বিএনপির দলীয় লোক। তবে রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে কেএম হাসানও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেন। এরপর ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমএ আজিজের পদত্যাগ ইস্যুতে আন্দোলন চালিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়। কিন্তু হঠাৎ সেনাবাহিনী ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয় ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে সবশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২৬৩টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। সে নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও কিছু বামপন্থী দলের সাথে একত্রিত হয়ে ‘মহাজোট’ গঠন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি, বিএনপি ৩৩টি, জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাসদ তিনটি, জামায়াতে ইসলামী দুটি, ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি আসনে জয়লাভ করে। দুই বছর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর আসা ওই নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট অংশ নিতে চাননি। কেননা নির্বাচনের আগে বিএনপির বড় বড় নেতাদের জেলে পাঠানো হয়। কারাদন্ড দেয়া হয় সাজানো দুর্নীতির মামলায়। পুরো দুই বছর বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের উপর রাজনৈতিক হয়রানী করা হয়। আওয়ামী লীগকে বিশেষ সুবিধা দিতে ১৩০টি সংসদীয় আসন কর্তন করা হয়। যেসব আসনের বেশিরভাগই বিএনপির নিয়ন্ত্রণ ছিলো। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য কেএম সাইফুর রহমান ও মেজর হাফিজের নেতৃত্বে বিএনপি ভাঙ্গার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। এরপরও তৎকালীন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদসহ অন্যান্য নেতাদের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যায় বিএনপি। যথারীতি সরকার নির্ধারিত নির্বাচনী ফলাফলে হেরে যায় বিএনপি। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং সংসদ নেতা হন শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া।
এককভাবে শক্তিশালী সরকার গঠন করে বেপরোয়া হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। আদালতের দোহাই দিয়ে নবম সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। সংবিধানে দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশের নির্বাচনকে স্থায়ীভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একতরফা ও বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে এই নির্বাচন বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে সরকার বিরোধীরা। আন্দোলনে ঢাকা থেকে কার্যত বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি-জাপাও নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। হঠাৎ করে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে এরশাদের সাথে বৈঠক করে জাপাকে জোরপূর্বক নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেন। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনে থাকার সুযোগ নিয়ে নতুন করে কিংস পার্টি গঠনের তৎপরতা শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ নামের একটি রাজনৈতিক দলও করা হয়, যার প্রধান আবুল কালাম আজাদকে ঢাকা-১৭ আসন থেকে পরবর্তীতে এমপি বানানো হয়। ওই দলের ব্যানারে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীকে নির্বাচন করানোর জন্য গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নামলেও সফল হয়নি। এমনকি আদালতের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনও বাতিল করা হয়।
একপর্যায়ে সরকারের কঠিন চাপে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর বিতর্কিত নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করতে বাধ্য হন। বিভিন্ন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপ দিয়ে নির্বাচন থেকে সরানো হয়। এজন্য নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোন ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। যা বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের শরীকরা এসব আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। ১৪৭টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ ৯৬টি আসন, জাতীয় পার্টি ১২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি চারটি ও জাসদ দুটি আসনে জয়লাভ করে। সবমিলিয়ে আওয়ামী লীগের ঝুলিতে আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৪টি, জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসন পায়। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। সে সংসদে জাতীয় পার্টি একদিকে সরকারের মন্ত্রীসভায় ছিল, অন্যদিকে তারা বিরোধী দলের আসনেও বসেছিল। ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে কেন্দ্র ফাঁকা ছিলো তবুও নির্বাচনে ৪০.০৪ শতাংশ ভোট দেখানো হয়। এই নির্বাচনটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়। ভারত এবং তার অনুগত দেশছাড়া স্বীকৃত কোন দেশে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। এরপর বাংলাদেশ নির্বাচন ব্যবস্থাপনার পচন শুরু হয়। ফ্যাসিবাদের চ‚ড়ান্ত রুপে গিয়ে দেশশাসন শুরু করে আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের ভোটে নগ্ন হস্তক্ষেপ শুরু হয়। সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের ভোটে আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগ। ২০১৫ সালে এক প্রকার কারোর পরামর্শ ছাড়াই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক সংযোজন করে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক প্রচলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক যিনি পেতেন তিনিই অবধারিত জয়ী হয়ে হতেন। কেননা পুলিশ, প্রশাসন থেকে শুরু করে নির্বাচনী কর্মকর্তা সবাই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ধ্বংসের উৎসবে মেতে থাকতেন।
একাদশ জাতীয় সংংসদ নির্বাচন: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই কলংকিত রাতের ভোটটি অনুষ্ঠিত হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অযৌক্তিক মামলায় সাজা প্রদান করে বিএনপি চেয়ারপার্সনকে কারাগারে পাঠিয়ে এই রাতের নির্বাচন আয়োজন করা হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কালাকানুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের ফাঁদে ফেলিয়ে নির্বাচনে আনা হয় বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলকে। কেননা পরপর দুইবার কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটির নিবন্ধন বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন। এছাড়াও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে যথেষ্ট আশ্বাস দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ ও কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘মহাজোট’ এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়। ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বে থাকলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চালিকাশক্তি ছিল বিএনপি। নির্বাচনে মোট ৩৯টি দল অংশ নেয়। ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমার শেষদিনের পর থেকে তান্ডব শুরু করে আওয়ামী লীগ, পুলিশ এবং প্রশাসন। ভোটের মাঠে কোথায় দাঁড়াতে দেয়নি বিএনপির কোন প্রার্থীকে। ভোটের প্রচারণায় প্রকাশ্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পেটানো হয়। পুলিশের সহায়তায় ভোটের মাঠ একতরফা দখল করে আওয়ামী লীগের পেটুয়াবাহিনী। নিরব এবং দর্র্শকের ভ‚মিকায় ছিলো নির্বাচন কমিশন। ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিলমারা হয়। নির্বাচনের আগের রাতেই অনেক জায়গায় ব্যালট-বাক্স নৌকা মার্কায় সিল মেরে ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্র্মকর্তাকে পেটানো হয়। সাজানো সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৮টি আসন পায়। এছাড়া জাতীয় পার্টি ২২টি আসনে জয়লাভ করে। সে নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ৮টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা। সংসদে বিরোধী দল হয় জাতীয় পার্টি এবং বিরোধী দলীয় নেতা হন এইচ এম এরশাদ। তার মৃত্যুর পর সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন রওশন এরশাদ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ আসনে ভোট হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ৩৯ দল অংশ নেয়। ৮০% ভোট পড়ে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো প্রায় তিনশতাধিক ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। প্রবাসী এবং অনেক মৃত ভোটাররাও এতে ভোটদান করেন। বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ভোট নিয়ে অবাক-বিষ্ময় প্রকাশ করেন। এছাড়া ভোটকে বৈধতা দেয়ার জন্য কানাডা থেকে ভাড়াটিয়া বিদেশী পর্যবেক্ষক আনে নির্বাচন কমিশন। দেশে-বিদেশে চরম বিতর্কিত হয় নির্বাচনটি। সাজানো-পাতানো ভোটের ফলাফল নিয়ে আরো পাঁচবছর দেশ শাসন করে আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পতন না হওয়া পর্যন্ত আর কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি বিতর্কিত ডামি নির্বাচন আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের এক তরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখে তা বয়কট করেছিল বিএনপি, জামায়াতসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে জেলখানায় রেখে নির্বাচনের পথে অগ্রসর হয় শেখ হাসিনা। দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন, তারা (বিএনপি) বলুক যে নির্বাচনে আসবে, সবাইকে আমরা কালকে ছেড়ে দেবো। তিনি আরো বলেন, “২০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার না করলে কি আর এই হরতালের দিন গাড়ি চলত? গণগ্রেফতার ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। যেটাই করা হয়েছে, আমরা চিন্তাভাবনা করেই করেছি। তার এ মন্তব্যের পর এ বিষয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। বিএনপি এ মন্তব্যকে সরকারের পরিকল্পিত মামলার "গুমর ফাঁস" হয়েছে বলে অভিহিত করে এবং দাবি করে যে আব্দুর রাজ্জাক "গণগ্রেফতারের" বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
প্রতিপক্ষবিহীন নির্বাচনকে জমজমাট করতে অভিনব ‘কৌশল’ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সমমনা জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাকের পার্টি, বিকল্প ধারা, কল্যাণ পার্টি, তরিকত ফেডারেশনসহ ১৪ দল থেকে সমঝোতার মাধ্যমে আলাদা প্রার্থী মাঠে নামায় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে নৌকা প্রতীকে নিজ দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায় দলটি। নিজেদের প্রতিপক্ষ নিজেরাই, নির্বাচনে নজিরবিহীন এবং অভিনব এসব প্রার্থীদের নাম শেখ হাসিনা নিজেই রাখেন ‘ডামি প্রার্থী’। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় আবারো কিংস পার্টি গঠনের পথে হাটে সরকার। বিএনপির সাবেক এমপি শাহ আবু জাফরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম এবং শমসের মবিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তৃণমূল বিএনপি নামে দু’টি রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে। তাদের লক্ষ্য ছিলো বিএনপির নেতাদের দল দু’টির ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো। শুধু দল গঠনের ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং বিএনপির মিত্রদের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় এবং আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের সদস্য হওয়ায় দলের অন্যজন সদস্য দলের মনোনীত প্রার্থীর প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে যান এবং সেখানে অন্যান্য দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। আন্দোলনরত বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো থেকে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে নিজের দল ছেড়ে অন্য দলগুলোতে চলে যান। যাদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও বিএনপির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহজাহান ওমর। শাহজাহান ওমরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ইস্যুটি একটি বিতর্কের জন্ম দেয়, কারণ তিনি আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে সরাসরি এর প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ঝালকাঠি-১ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপিও হয়ে যান। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার একদিন আগে তিনি ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার অবস্থা থেকে জামিন পেয়েছিলেন। যদিওবা একই মামলায় সেদিন অন্যান্য বিএনপির নেতারা জামিন পাননি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ২৯৮ আসনের চূড়ান্ত ফলাফলে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ২২২টি আসনে, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১ আসনে এবং জাসদ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি করে আসনে জয়ী হয়েছে। আর ৬২টি আসনে জয়ী হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যারা সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এমনকি জাতীয় পার্টি যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেখানে আওয়ামী লীগ কোন প্রার্থী দেয়নি। নির্বাচনী ময়দানে আওয়ামী লীগের মিত্র দল এবং নিজ দলের নেতাকর্মীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ডামি প্রার্থী’ বানিয়ে ‘ডামি নির্বাচনের’ তরী পার হয়ে টানা চার মেয়াদের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত গদি রক্ষা করতে পারেননি শেখ হাসিনা। এ বছরের ৭ জানুয়ারি মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ‘ডামি নির্বাচনের’ মাধ্যমে দ্বাদশ সংসদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। পারস্পরিক সমঝোতায় সংসদের ‘ডামি বিরোধী দলের’ দায়িত্ব নেয় স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকার পাশাপাশি জাতীয় পার্টি থেকে কয়েকজন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিপরিষদেও থাকার চেষ্টা করেছিল। আরও বেশি বিতর্ক এড়াতে আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের অনাচার-অবিচার শেষে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন ফ্যাসিবাদ শাসক শেখ হাসিনা।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুতির পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গত ৮ আগষ্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে এ এমএম নাসিরউদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসকে টার্গেট করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই লক্ষ্যে রোডম্যাপ প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্র্তাদেরও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা দিয়ে প্রস্তুত হতে কঠোর নির্র্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর সকালে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অর্ন্তবর্তীকালীণ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয় তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। তিনি আরো বলেছেন, ‘প্রথমে সবচেয়ে বড় কাজ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। এটা এমনিতেই কঠিন কাজ। এখন কাজটা আরও কঠিন হলো এ জন্য যে গত তিনটা নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না।’ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ বলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। রোডম্যাপ ঘোষণার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনে কোন সমস্যা হবে না। যদিও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো আরও আগেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।
২০২৪ সালের গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। আন্দোলনটি আমাদের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল, যা বিশ্বের অনেক মানুষের জন্য বিস্ময়কর। ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সমাজের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যেখানে বৈষম্য, মুক্তিযুদ্ধের অপব্যবহার, দলীয় রাজনীতি, অপবাদ এবং ঘৃণা থাকবে না। শিক্ষা, আইনের শাসন, রাজনৈতিক সংস্কার, সামাজিক সমতা, প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক সম্পীতি এবং যুব নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি সুন্দর এবং আধুনিক সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। তবে জনগনকে নিজের ভোট নিজের পছন্দের প্রার্থীকে দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত ১৫টি বছর ভোটাধিকার বঞ্চিত বাংলাদেশ জনগন ভোটদানের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় আগামীর ভোটে প্রভাব বিস্তার রোধ করে, সুষ্ঠু ভোটদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত নতুন বাংলাদেশ "যাকে খুঁশি তাকে ভোট দেওয়ার দীর্ঘদিনের পুরাতন প্রথা ফিরিয়ে আনতে সকলকেই সচেষ্ট থাকতে হবে। আগামীতে একটি সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার এই প্রচেষ্টা আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব এবং কর্তৃব্য। [২৮ ডিসেম্বর সকাল ১১টায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় দ্যা ডেমোক্রেসি টক আয়োজিত কর্মশালায় পঠিত]
লেখক: রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশনবিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক