বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে শুধু কি শিক্ষকরাই বিচারের কাঠগড়ায়?

মো. শামসুল আলম 
মো. শামসুল আলম   © সম্পাদিত

বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার কোন সুযোগ থাকা উচিত নয়। কয়েকদিন ধরে শিক্ষকদের ওপর যে অত্যাচার চলছে (জনগনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে), তা মোটেও কাম্য নয়। আবার এক শ্রেণির লোক এটাকে বৈধতা দিচ্ছেন, সে ব্যাপারে কিছু কথা; দেখেন স্বৈরশাসকের সময় কার কি ভূমিকা ছিল, তা সব মানুষের কাছে পরিষ্কার। শিক্ষক, আমলা, পুলিশ আইনজীবী থেকে শুরু করে এমন কোনও সেক্টর ছিল না, যারা সরকারের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পেরেছে। তাছাড়া  সরকারি চাকরিতে সরকারের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা কখনো কি সার্ভিস রুল অনুযায়ী সম্ভব? কেউ কি বিগত ১৫ বছর করেছে?

৩ আগস্ট আমার কলেজের এক শিক্ষকের প্রাইভেট গ্রুপে এক শিক্ষার্থীর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে পোস্ট দেওয়ায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ৫০-৬০ জন লাঠি নিয়ে স্যারকে মারতে আসে। তাঁর অপরাধ কি? কই তখন তো শিক্ষার্থীরা ও তার পাশে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ প্রতিকূল পরিবেশ ছিল। ঠিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন বিগত সরকার থামাতে পারলে শিক্ষকদেরই বেশি চাকরি চলে যেত। কারণ শিক্ষকরাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেছে বেশি। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও আছে, যেখানে কিছু শিক্ষকের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকাও ছিল।

এখন অনেকেই বলছেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন থেমে গেলে এই শিক্ষকরাই ছাত্রদের  লিস্ট দিত। ভেবে দেখেছেন, এটা শিক্ষকরা কখনো করেছে? বা করতে পারতো? বা তার কি প্রয়োজন হতো? তাদের ছাত্র সংগঠন ও নেতাকর্মীরায় তো এগুলো করার জন্য যথেষ্ট। এমনকি তারা মাটির নীচ থেকে বিরোধী শিক্ষার্থীদের  তুলে নিয়ে আসতো, এটা আমাদের কারোরই অজানা বিষয় নয়। নাকি শিক্ষকরা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে তাদের ধরে নিয়ে আসতো? কোনটা ঠিক?

ক্ষমতা হারানোর সাথে সাথে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা, সরকারি হাই প্রোফাইল ব্যাক্তিবর্গ পালিয়েছেন। এমনকি জাতীয় মসজিদের ইমাম ও পালিয়েছেন। কই কোন শিক্ষক কি পালিয়েছেন? দিব্বি ৬ আগস্ট থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন (বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত)। স্বৈরাচার সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা কি শিক্ষকরাই বেশি করেছেন, নাকি অন্য সরকারি কর্মকর্তারা? কারা কারা বেশি সহযোগিতা করেছে; যদিও আমরা জানি তারপর ও উত্তর না হলে, তাদেরকে দায়মুক্তি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোন ভূমিকা না নিয়ে শিক্ষকদেরকে কেন অপদস্ত করা হচ্ছে?

পিতা-মাতার পরেই যদি শিক্ষকদের অবস্থান আমরা বলি, তাহলে কি আমরা তাদেরকে এভাবে অপমান অপদস্ত করতে পারি? নিজের পরিবারের জায়গা থেকে একটু ভাবি। এটা সত্য যে শিক্ষকদের মাঝে কিছু অতি উৎসাহী, দলবাজ, দূর্নীতিগ্রস্থ  লোক আছে। এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। এটা সব সার্ভিসে আছে। তাদের সংখ্যা ১ থেকে ৫ শতাংশ। তাদেরকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হওয়া উচিত। আর এ জন্য তাদেরকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শাস্তি, বরখাস্ত, অপসারণ করানো যেতে পারে।

আরো পড়ুন: নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ এদেশের শিক্ষায় শিক্ষিত 

এটা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। তাই বলে শিক্ষার্থীরা সরাসরি অপদস্ত করবে, বিচার করবে- এটা কেমন দেখায়? এখানে কি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে সম্পর্কে চিড় ধরছে না? মনে রাখতে হবে, দেশের-বিশ্বের একপ্রান্তের শিক্ষার্থী আহত হলে যেমন অন্য প্রান্তের শিক্ষার্থীরা আহত হন। তেমনি দেশের বা বিশ্বের একপ্রান্তের শিক্ষক আহত হলে অন্য প্রান্তের শিক্ষকরা ও আহত হন।

সর্বোপরি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, তোমার সফলতায়, তোমার পিতা-মাতার পরে সবচেয়ে খুশি হয় তোমার শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা সফল হলে শিক্ষকের গর্বে বুক ভরে যায়। এটা শিক্ষক হিসেবে আমি অনুভব করি। সুতরাং দেশকে বৈষম্যমুক্ত করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কটা যে জায়গায় রাখা উচিত, সে জায়গায় রাখা শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই সমান দায়িত্ব। 

লেখক: প্রভাষক, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা
লোহাগড়া সরকারি আদর্শ কলেজ, নড়াইল


সর্বশেষ সংবাদ