বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে যা ভাবছেন বুটেক্স শিক্ষার্থীরা  

  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিষয়ক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি দেশে আলোচনার তুঙ্গে রয়েছে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গটি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্ররাজনীতি চালু রাখা হবে কি হবে না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা জটিল প্রশ্ন।

এক সময় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকলেও ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বুয়েটের দেওয়া এক জরুরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির ইতি ঘটে। এর মূলে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির শেরে বাংলা হলে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা ও ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে বুয়েট শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলন। 

তবে চলতি বছরের মার্চ মাসের দিকে এসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি চালু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্রলীগের সদস্যরা। অপরদিকে আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা চায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রাখতে। পাল্টাপাল্টি দাবিতে এখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বুয়েট ক্যাম্পাস।

গত ১ এপ্রিল বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। এছাড়া গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বুয়েটের উপাচার্য হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন বলে জানান। কিন্তু বুয়েটের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা এখনো ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। 

বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি কি আসলেই শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর হবে নাকি পুনরায় এর মাধ্যমে অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত হবে? এ ধরনের প্রশ্নকে সামনে রেখে বুয়েটে রাজনীতি প্রসঙ্গে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) কয়েকজন শিক্ষার্থী। চলুন শুনি তাদের কথা—

বুটেক্সের ৪৫তম ব্যাচের ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী জুয়েল রানা রেজা বলেন, ছাত্ররাজনীতি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভিত্তি। এ দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেই ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রদের, বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ রয়েছে। সুসাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি সর্বদাই ছাত্রদের অধিকার আদায়ে, দেশের অধিকার রক্ষায় একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। 

বর্তমান বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক দুর্জন হলে সম্পূর্ণ স্কুলটা বন্ধ করে দেওয়া যেমন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, তেমনি এক বছরের নেতৃত্ব খারাপ হওয়ায় পুরো ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা আপাতদৃষ্টিতে ঠিক মনে হলেও দূরদৃষ্টিতে তা দেশের জন্য এবং জাতির জন্য ক্ষতিকর ও উন্নতির অন্তরায়। রেষারেষির ছাত্ররাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থের ছাত্ররাজনীতি, প্রতিহিংসার ছাত্ররাজনীতি প্রতিহত করে বুয়েটে সুশৃঙ্খল ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। আজকের ছাত্ররা ভবিষ্যৎ সোনার বাংলার চালিকাশক্তি। দেশের ভিত্তিপ্রস্তর শক্ত করতে হলে শিক্ষিত এবং মেধাবী জনশক্তির রাজনীতিতে অংশগ্রহণ অতীব প্রয়োজনীয়। তাই বুয়েটে অবশ্যই ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজন।

৪৬তম ব্যাচের ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী এফ এম‌ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বুয়েটের মতো বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থীরা যখন ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে মাঠে নেমে আসে, তখন আমাদের বুঝতে হবে এটা অন্য যেকোনো সাধারণ প্রেক্ষাপট আর যুক্তি দিয়ে তুলনা করার সুযোগ নেই। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সেখানখার অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের মতামতের বাইরে এসে বহিরাগত কারো কথায় রাজনীতি বন্ধ অথবা শুরু করার সুযোগ দেয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে বুয়েট কর্তৃপক্ষ বর্তমান শিক্ষার্থীদের অফিশিয়াল মতামত নিতে পারে হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা না ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক। ছাত্ররাজনীতি ব্যতীত বিগত ৪ বছরে বুয়েট ক্যাম্পাস যেহেতু নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলো, তাই এখানে পুনরায় ছাত্র রাজনীতি এনে সনি কিংবা আবরার ফাহাদের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিলে সামনে কারো নাম যুক্ত করার পথ সুগম করে দেয়া হচ্ছে কিনা এ ব্যাপারেও পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। পরিশেষে বুয়েট শিক্ষার্থীরা চাইলে 'ছাত্র সংসদ' নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা করতে পারেন। এক্ষেত্রে কোনো দল বা এলাকাভিত্তিক রাজনীতি বাধ্যবাধকতা নেই বলেই আমি মনে করি।

৪৮তম ব্যাচের ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মাহামুদুল হাসান জানান, ছাত্ররাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এই মূলভিত্তির উপর। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি তাদের মত প্রকাশে কোনো সাংগঠনিক উপায়ের সহযোগিতা নিবে? তারা কি তাদের মত প্রকাশ করার, অধিকার তুলে ধরার সুযোগ থেকে বঞ্চিত? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে শিক্ষার্থীরা কি চাইলেই যোগাযোগ করতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া গেলে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে। আর উত্তরগুলো কেবল সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছেই পাওয়া সম্ভব। 

প্রশ্ন আরো আছে, প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্ররাজনীতি কি আদতে শিক্ষার্থীদের জন্যে কাজ করতে সক্ষম? নির্দিষ্ট দল কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন কি সাধারণ ছাত্রদের হয়ে প্রকৃতপক্ষে কাজ করবে নাকি স্বার্থান্বেষী মহলের প্রতিপত্তি বিস্তারে ভূমিকা রাখবে? 

শিক্ষার্থীদের পূর্বাভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাস প্রশ্নগুলোকে আরো জটিল করে তুলেছে শিক্ষার্থীদের কাছে। শিক্ষার্থীরা চায় সুস্থ-সুন্দর শিক্ষার্থী বান্ধব ক্যাম্পাস তার জন্য প্রথম শর্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা। অন্যথায় জোরপূর্বক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি আতঙ্ক ছাড়া কিছুই নিয়ে আসবে না।

একই ব্যাচের ডাইজ অ্যান্ড কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী শাফিউল ইসলাম জানান, স্বাধীনতার পূর্বে ছাত্রনেতাদের হাত ধরে বহু বিজয়গাঁথা ইতিহাস বাঙালি জাতির রয়েছে। ছাত্ররাজনীতি মূলত ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত, নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি এবং ছাত্রদের দাবি আদায় করার উদ্দেশ্যই পরিচালিত হয়। ভবিষ্যতে এই ছাত্র নেতাদের হাত ধরেই দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। বর্তমানে বেশির ভাগ তরুণ শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরাও সন্তানের রাজনীতিতে জড়ানোর বিষয়কে অত্যন্ত ভয়ের চোখে দেখেন। রাজনীতিতে অনীহার কারণ মারামারি, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, খুন, ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক কিছু বিষয়। বুয়েটের আবরার ফাহাদকে হত্যার পর থেকেই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এখন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুনরায় জাগ্রত করতে তৎপর ছাত্রলীগ নেতারা। অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চায় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধই থাকতে। কারণ তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চায় না। অতীত ইতিহাসে ছাত্রদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও বর্তমানে মেধাবীরা তাদের মন ফিরিয়ে নিচ্ছেন ছাত্ররাজনীতি থেকে। এক্ষেত্রে বলতে হয় ছাত্ররাজনীতি নয় বরং বন্ধ হওয়া উচিত ছাত্ররাজনীতির নামে ‘অপরাজনীতি’।  ছাত্রবান্ধব ছাত্ররাজনীতির চর্চা শুরু করা গেলে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ও জাতির কল্যাণের পথ মসৃণ হবে।

৪৯তম ব্যাচের ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী এহসানুল হক রাফি বলেন, একটা স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দেশে ছাত্রদের কেন পড়াশোনার পরিবর্তে ছাত্ররাজনীতি করতে হবে? তার‌ উত্তর যদি হয় ভবিষ্যতে রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা। তাহলে আমার পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমানে পৃথিবীর কয়টা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি চালু আছে? আমাদের প্রতিবেশী কয়টা দেশে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাজনীতি করছে? ভারতের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশেও ছাত্র রাজনীতি বলে কিছু নেই। তাহলে আমাদের দেশে কেন এখনো ছাত্র রাজনীতি এতটা জরুরি? 

ছাত্র রাজনীতির কারণে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে তথাকথিত জোট তৈরি হচ্ছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাপুষ্ট বেপরোয়া শিক্ষার্থী বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এমনটি মনে করেন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, রাজনীতির এমন খেলায় ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ায় নজীর অনেক রয়েছে। এই অসুস্থ চর্চার কারণে বুয়েটের আবরার আজ আমাদের মধ্যে নেই।ছাত্ররাজনীতি আবার বুয়েটের বুকে পদার্পণ করলে আবার কত আবরারের বলি হবে তা নিয়ে ভয়ার্ত বুয়েটিয়ানরাই আজ আন্দোলনরত রয়েছে। ক্ষমতার সুপ্রয়োগ করে দল এবং দেশ পরিচালনার জন্য যে হাতেখড়ি দরকার তা আর যেখানে হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন নেই। তাই ছাত্ররাজনীতির মত নিন্দিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা বুয়েটসহ দেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

একই ব্যাচের শিক্ষার্থী এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী জসিবুল হাসান জানান, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চলবে কিনা এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। চলমান অবস্থায় ছাত্রদের ভাষ্যমতে বুয়েটে র‍্যাগিং কালচার, অত্যাচার, চাঁদাবাজি, হলের অনিয়ম চলেছিল। রাজনৈতিক কারণে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি আবরার, সনি ও দীপদের মতো মেধাবী ছাত্রদের নৃশংসভাবে হত্যা করা করেছে। আবরারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তুমুল আলোচনা ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বুয়েটে র‍্যাগিং কালচার, অত্যাচার, চাঁদাবাজি বন্ধ হয় এবং হলের খাবারের মান উন্নয়নসহ পড়াশোনারও অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। কথিত রাজনৈতিক দল পুনরায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে চায়। তবে বুয়েটের ৯৭ ভাগ ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার রয়েছে। যেহেতু সিংহভাগ শিক্ষার্থী চায় না বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফিরে আসুক, কথিত রাজনৈতিক দলের উচিত নয় জোর করে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।

 

সর্বশেষ সংবাদ