বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষকদের ঘোষিত কর্মসূচি! মূল কুশীলব কে?

 ড. সোলাইমান হোসেন মিন্টু
ড. সোলাইমান হোসেন মিন্টু   © টিডিসি ফটো

আলোচনা শুরু করি কর্মসূচির পেছনের গল্প থেকে। এরপর কুশীলব কে তা খোঁজার চেষ্টা করি। শিক্ষকদের উত্থাপিত ছয় দফার মাঝে পাঁচটা দাবি বেশ পুরোনো। উক্ত দাবিগুলোর মধ্যে তিনজন শিক্ষকের প্রমোশন বাদে বাকি চারটা দাবি শিক্ষকগণ উত্থাপন করেন গত বছরের অক্টোবরের দিকে। এরপর নানান গড়িমসি করে মাননীয় উপাচার্য মহোদয় প্রায় ৯ মাস রিজেন্ট বোর্ডের কোনো সভার আয়োজন করেননি।

এরপর এ বছরের জুন মাসের ২৩ তারিখ ঈদের ছুটির মাঝে মাননীয় উপাচার্য ৩৩-তম রিজেন্ট বোর্ড করেন এবং এর ঠিক পরপরই ৮ জুলাই ৩৪-তম রিজেন্ট বোর্ডের সভা সম্পন্ন করেন। উক্ত দু'টো রিজেন্ট বোর্ড সভায় তিনি শিক্ষক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট  দাবিসমূহ বোর্ডে উপস্থাপন করলেও, এর কোনটিই তিনি পাশ করাতে ব্যর্থ হন। এর সাথে আরও যুক্ত হয় তিনজন শিক্ষকের প্রমোশন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সংবিধি লঙ্ঘন করে আটকে দেওয়া। 

৩৪-তম রিজেন্ট বোর্ডের পর ১৮ জুলাই, ২০২৩ বর্তমান শিক্ষক সমিতি সাধারণ শিক্ষকদের নিয়ে একটি সাধারণ সভা আয়োজন করে। উক্ত সভায় শিক্ষকগণের মাঝে সার্বিক বিষয় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয় এবং সভায় উপস্থিত সমস্ত শিক্ষকের সমর্থন নিয়ে সম্মানিত শিক্ষকদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করে দেয়া হয়, যাতে যাবতীয় অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বিষদ আলোচনা করে শিক্ষকগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দাবিসমূহ তাঁরা সমিতিকে তৈরি করে দিতে পারেন। উক্ত বিশেষ কমিটি শিক্ষক সমিতির উত্থাপিত ৫ দফা/দাবি পরবর্তী সময়ে সমিতি বরাবর পেশ করে। 

শিক্ষক সমিতি উক্ত দাবিসমূহ মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের সাথে তাদের পরবর্তী সাক্ষাৎকারে উপস্থাপন করে। মাননীয় উপাচার্য সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির বাইরেও অন্যান্য অনেক শিক্ষকগণের সামনে সেসময়ে আশ্বাস দিয়ে জানান যে, “এই দাবিগুলো যৌক্তিক দাবি, আমি এই দাবির পক্ষে পরবর্তী রিজেন্ট বোর্ডে বিষয়গুলো উত্থাপন করবো এবং পাশ করিয়ে নিতে পারবো"। উপস্থিত সকল শিক্ষক উপাচার্য মহোদয়ের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিশ্চিন্ত মনে তখন তাঁর কার্যালয় ত্যাগ করেন।

এরপর ৩৫-তম রিজেন্ট বোর্ড শুধু বাজেট আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট, এরকম একটি ধোঁয়া তুলে তিনি শিক্ষকদের উক্ত পাঁচ দফা দাবি আর রিজেন্ট বোর্ডে তুললেন না। এরপর গত ২৯ তারিখের ৩৬-তম রিজেন্ট বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত রিজেন্ট বোর্ডের পূর্বেও মাননীয় উপাচার্য শিক্ষকদের সামনে প্রতিজ্ঞা করেন যে শিক্ষক সমিতির উত্থাপিত ১-২টা দাবি বাতিল হলেও হতে পারে, তবে সিংহভাগ দাবিই আলোর মুখ দেখবে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষক সমিতি তাঁর পূর্বের কিছু কর্মকাণ্ড ও শিক্ষার্থীদের সাথে পূর্বেও তাঁর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন আশ্বাস দিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার অভিজ্ঞতা থেকে, এবার তাঁর প্রশাসন বরাবর রিজেন্ট বোর্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই একটি আল্টিমেটাম (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩) দিয়ে রাখে। পরবর্তী সময়ে দেখা যায় সমিতির পূর্বানুমানই সত্যে পরিণত হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে পূর্বোল্লেখিত সাধারণ সভায় সাধারণ শিক্ষকগণ এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে মর্মে আশংকা প্রকাশ করে, শিক্ষক সমিতিকে প্রয়োজনে যেকোনো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণে সমর্থন দিবে বলে সর্বসম্মতিক্রমে জানিয়ে রেখেছিলো। আপনারা অবগত রয়েছেন, শিক্ষক সমিতি মূলত শিক্ষকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত ও নির্বাচিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিধায় তাদের উপর শিক্ষকগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব বিশেষভাবে অর্পিত।

এখানে আরও উল্লেখ্য শিক্ষকগণের দাবিকৃত উক্ত ৬-দফার মধ্যে কয়েকটি দাবি-দাওয়া নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার রিজেন্ট বোর্ডের বেশ কয়েকজন সম্মানিত সদস্যের সাথেও শিক্ষক সমিতি, সাধারণ শিক্ষকগণকে সঙ্গে করে নিয়ে সাক্ষাৎ করে এসেছে। এমনকি উক্ত বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সমিতি সাধারণ শিক্ষকদের উপস্থিতিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা সহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের সাথে দফায় দফায় সভার আয়োজন করেছে। এমতবস্থায় প্রশাসনের গড়িমসি প্রত্যক্ষ করে তারা সাধারণ শিক্ষকগণের পরামর্শে  ইতোপূর্বে একবার প্রশাসনিক অবরোধও আরোপ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে প্রশাসনিক আবরোধ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যু (যেমন-হিয়া-ঋতুর দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যু) ও দেশের সার্বিক জাতীয় প্রয়োজনের প্রতি সম্মান রেখে শিক্ষকগণ সেসময়ে প্রত্যাহারও করেন। কিন্তু শিক্ষকগণ যতটা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হয়েছেন, প্রশাসন ততটাই শিক্ষকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুসমূহের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করেছে।

এরপরের ঘটনা আপনাদের সকলের জানা। শিক্ষকগণ তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করার ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করে এসেছেন। সর্বশেষ বর্তমান নির্বাচিত কমিটি তাদের দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রায় ৯ মাসের দীর্ঘ ধারাবাহিক বিভিন্ন কর্মসূচির পরে বর্তমানের (একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের) উক্ত কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য এসময়ে ভিসি মহোদয় ঢাকায় ছিলেন। তিনি কর্মসূচি ঘোষণার পরে রবিবার (২ অক্টোবর) তাঁর কর্মস্থলে ফিরলেন বটে কিন্তু একবারের জন্যও শিক্ষকগণের ঘোষিত কর্মসূচিকে আমলে নিলেন না।

এমনকি উক্ত ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবে রূপ নিলে শিক্ষার্থীদের কী হবে এ কথাও ভাবলেন না, শিক্ষকদের কথা তো চিন্তাও করলেন না। তিনি সারাদিন একবারের জন্যও সমিতির দায়িত্বশীল কারও সাথে যোগাযোগ করেননি। অপরপক্ষে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাংবাদিকদের কাছে শিক্ষকদের সম্পর্কে নানান ধরনের উস্কানিমূলক মিথ্যা, বানোয়াট মনগড়া বহু বক্তব্য দিয়ে গেলেন। একবারের জন্যও সমস্যা সমাধানের কথা ভাবলেন না। 

সারাদিন যাওয়ার পরে সন্ধ্যার পর তাঁর মনে হলো বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের সাথে বসা দরকার। এদিকে শিক্ষকগণ সব সময়েই চেয়েছেন এবং এখনও তাঁরা প্রত্যাশা করেন এসব দাবি-দাওয়া প্রশাসনের সাথে টেবিলে বসেই সমাধান করতে, তাঁরা সবসময়েই চেয়েছেন এমন অচলাবস্থার অবসান হোক। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন তাঁদের কোনো ধরনের অনুরোধ-অভিযোগকেই একবারের জন্য আমলে নেয়নি, এর উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে। সুতরাং এমতবস্থায় শিক্ষকগণ অত্যন্ত নিরুপায়। তাঁরা নিতান্তই অপারগ হয়েই এমন কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। মাননীয় উপাচার্য শিক্ষকগণের এমন অনড় অবস্থান প্রত্যক্ষ করে রবিবার রাতে সমিতির সভাপতিকে ফোন দিয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। সমিতি তখন তাঁর কাছে রিজেন্ট বোর্ডের মিটিং মিনিটস তাঁর সাথে আলোচনা করার পূর্বে দেখতে চায় বলে জানায়। তিনি সোমবার (৩ অক্টোবর, ২০২৩) দুপুর ২:৩০ মিনিটে মিটিং কল করেন এবং বেলা ২:০০ টার সময়ে মিটিং মিনিটস সমিতির হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সমিতি মিটিং মিনিটস হাতে পাওয়ার পর তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে, তিনি এবার অদ্ভুত রকমের তাল-বাহানা শুরু করেন। বিস্ময়করভাবে তিনি শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় না বসে বরং ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে চলে যান। এরপর সমিতির সভাপতি তাঁকে ফোন করে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে, তিনি প্রত্যুত্তরে জানান যে পরবর্তী রবিবারের (৮ অক্টোবর, ২০২৩) পূর্বে তিনি কারোর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। এই হলো আজ পর্যন্ত আদ্য-প্রান্ত।

এবার বিচার করুন কে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশীজন (স্টেকহোল্ডারদের) নানাবিধ সমস্যার পেছনের কারিগর? কেন উনি শিক্ষকদের সামনে তাঁরই করা প্রতিজ্ঞা বারংবার ভঙ্গ করলেন? কেন তিনি মিটিং মিনিটস দিয়ে কারও সাথে আলাপ না করে ক্যাম্পাস ছেড়ে এভাবে চলে গেলেন? তিনি কি আসলেই অচলাবস্থার নিরসন চান? তিনি কি শিক্ষকদের পক্ষে নাকি শিক্ষার্থীদের? নাকি নিজের কোনো ধামা ধরার পক্ষে? তাঁর কি উচিত ছিলো না এমন সংকটময় সময়ে শিক্ষকদের সাথে সময় নিয়ে বসা! তাঁর কি উচিত ছিলো না শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ করা! তিনি এর কিছুই করতে পারতেন না? 

উনি আসলেই পারতেন না! কেননা তাঁর উক্ত সৎ সাহস নেই। সৎ সাহস নেই শিক্ষকদের মুখোমুখি হওয়ার!

মাননীয় উপাচার্য মহোদয়! শিক্ষকরা আপনাকে অভয় দিচ্ছেন, আপনি আসুন। শিক্ষকদের সাথে বসুন। শিক্ষকদের সাথে বসেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।কোনো কূটচাল, হম্বিতম্বি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যার সমাধান আছে সকল শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসার মধ্যে, শিক্ষকদের নিয়ে গীবত করায় নয়। শিক্ষার্থীদেরকে নানানভাবে বঞ্চিত করে নিজ প্রশাসনের প্রয়োজনে এখন মেকি শিক্ষার্থীবান্ধব সাজায় নয়। এই "ডিভাইড এন্ড রুল গেইম" বহু পুরোনো খেলা এবং আপনি বর্তমানে এর মূল কুশীলব। এমনকি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের দিনের পর দিন অসন্তুষ্ট রেখে আর তাদের নামে মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়ে প্রশাসন চালানোতে ব্যর্থতা দায় আড়াল করতেই আপনি ও আপনার প্রশাসন এই মুহুর্তে সবার মাঝে গোলমাল উস্কে দিয়ে ও জিইয়ে রাখছেন।

অথচ নিজের অক্ষমতা ঢাকতে এখন উলটো শিক্ষকদেরই চোখ রাঙানো ও অনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া দিয়েই আপনি সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে সমাধান আসবে না। শিক্ষকদের সাথে বসুন, আলোচনা করুন। এতেই কেবল সমাধান আসতে পারে, অন্যথায় নয়। এখনও সময় আছে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ ও দপ্তর সম্পাদক শিক্ষক সমিতি, বশেমুরবিপ্রবি


সর্বশেষ সংবাদ