শহীদদের মামলায় আসামি ব্যক্তিগত শত্রু, চলছে টাকার খেলা

মামলা ও গ্রেফতার প্রতিকী ছবি।
মামলা ও গ্রেফতার প্রতিকী ছবি।  © সম্পাদিত

কোটা সংস্কারে আন্দোলন ঠেকাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় কর্মীদের দিয়ে গুলি করে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। তবে ছাত্র-জনতার প্রবল বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আন্দোলনরতদের হত্যার এসব ঘটনায় একের পর এক মামলা দায়ের হচ্ছে। মামলাগুলোর আসামি তালিকাও দীর্ঘ। শহীদদের মামলায় অনেক ক্ষেত্রেই আসামির তালিকায় ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক শত্রুর স্থান হচ্ছে। ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের। অভিযোগ আছে, টাকার বিনিময়ে মামলায় নাম দেওয়া হয় এবং টাকা দিলে মামলা থেকে নাম কাটা হয়।

যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটনার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি দেশেই ছিলেন না। এমনই একটি মামলার আসামি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। জাতীয় দলের এ ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে ঢাকার আদাবর থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। ঘটনার সময় সাকিব ছিলেন দেশের বাইরে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলি, সংঘর্ষ ও বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় গত ১৬ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ৭৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থী, নারী, শিশু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ ঘটনাস্থলে আবার কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে হাসপাতালে মারা গেছেন।

গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর পর থেকে গতকাল রবিবার পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ১৭৭টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৫৭টিই হত্যা মামলা। এসব মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তার নেতৃত্বাধীন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের তালিকায় সাবেক দুই আইজিপিসহ ৮৮ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।

গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর পর থেকে গতকাল রবিবার পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ১৭৭টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৫৭টিই হত্যা মামলা। এসব মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তার নেতৃত্বাধীন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের তালিকায় সাবেক দুই আইজিপিসহ ৮৮ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।

আরও পড়ুন : টাকায় নির্দোষ মানুষ মামলায় ঢুকছে, আবার টাকার বিনিময়ে বাদ পড়ছেন

কোনো কোনো মামলায় শেখ হাসিনাসহ প্রায় চারশ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় নাম উল্লেখের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে। মামলার আসামিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। কোনো কোনো মামলায় দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আসামি করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নেতারাও আসামি। এ ছাড়া প্রায় সব মামলায় স্বাভাবিক কারণেই বিগত সরকারের সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। কিছু মামলায় সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বেসরকারি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী রবিউস সানি শিপু। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর, সাবেক সচিব ফেরদৌস জামান, সাবেক সদস্য ড. বিশ্বজিৎ চন্দ, ড. সাজ্জাদ হোসেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুক, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. জামিনুর রহমান, মো. ফজলুর রহমান, উপ-পরিচালক মৌলি আজাদ, মো. গোলাম দস্তগীর, ইউসুফ আলী খান ও অতিরিক্ত পরিচালক শাহীন সিরাজ, সহকারী পরচিালক ফরিদুজ্জামান এবং মো. শরিফুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে। 

বাদি রবিউস সানি শিপু দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বন্ধ ঘোষণা করার জন্য বল প্রয়োগের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। অনেকে সরাসরি জুলাই গণহত্যার সাফাই গেয়ে এটিকে সমর্থন জানায়। ফলে আমি তাদেরকে আসামি করে মামলা করেছি।

প্রায় তিন দশক আগে আলোড়ন সৃষ্টকারী জনপ্রিয় বাংলা নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের মূল ‘বাকের ভাই’ চরিত্রে অভিনয়কারী সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও গ্রেফতার হয়েছেন। গতকাল রবিবার তাকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাজধানীর মিরপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় আসাদুজ্জামান নূরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

প্রায় তিন দশক আগে আলোড়ন সৃষ্টকারী জনপ্রিয় বাংলা নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের মূল ‘বাকের ভাই’ চরিত্রে অভিনয়কারী সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও গ্রেফতার হয়েছেন। গতকাল রবিবার তাকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাজধানীর মিরপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় আসাদুজ্জামান নূরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যাতে যাচাই করে নেয় যে কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয়। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার, তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সেই খাগড়াছড়িতে কোনো ঘটনা ঘটেছে, সেটার মামলা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা দেশের (আওয়ামী লীগের) নেতাদের কেন্দ্র করে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।-বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম

ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যাতে যাচাই করে নেয় যে কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয়। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার, তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সেই খাগড়াছড়িতে কোনো ঘটনা ঘটেছে, সেটার মামলা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা দেশের (আওয়ামী লীগের) নেতাদের কেন্দ্র করে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

মামলা-মামলা খেলা চলছে। টাকার বিনিময়ে মামলায় নাম দেওয়া হয় এবং টাকা দিলে মামলা থেকে নাম কাটা হয়। সব জায়গায় টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া কোনও কাজ হয় না। এজন্যই কি এত ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছিল? এসব চলবে না, আর করতে দেওয়া হবে না একটা জিনিস শুধু খেয়াল করবেন, বিনা দোষে যেন কাউকে হয়রানি না করা হয়। ।-সমন্বয়ক সারজিস আলম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম গত শনিবার ঠাকুরগাঁওয়ের এক অনুষ্ঠানে বলেন, অভিযোগ পেয়েছি, মামলা-মামলা খেলা চলছে। টাকার বিনিময়ে মামলায় নাম দেওয়া হয় এবং টাকা দিলে মামলা থেকে নাম কাটা হয়। সব জায়গায় টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া কোনও কাজ হয় না। এজন্যই কি এত ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছিল? এসব চলবে না, আর করতে দেওয়া হবে না। দেশে এখন থেকে যা কিছু হবে, তা ছাত্র-জনতার রায়ে হবে। কোনও ফ্যাসিবাদী শক্তি কিংবা কোনও পরিবারতন্ত্রের রায়ে কিছু হবে না।

আরও পড়ুন : সাবেক চেয়ারম্যানসহ ইউজিসির ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এআইইউবি শিক্ষার্থীর মামলা

গতকাল রবিবার মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সব সদস্য সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ আছে তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচার হবে। অন্যায় অন্যায়ই, কাজেই যে দোষী, তার বিচার হতে হবে। কেউ অতি উৎসাহী হয়ে, ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে নিজের বীরত্ব তুলে ধরতে অন্যায়ভাবে নির্দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন। এ কাজগুলা যারা করেছেন তারা অন্যায়কারী। তিনি যদি পুলিশের কেউ হন, তার বিচার করতে হবে। পুলিশের যদি বিচার না হয় তাহলে আরেকজনের ক্ষেত্রেও বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

সারজিস আরও বলেন, আপনারা যদি মামলা করতে চান, এক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, আমরা সহযোগিতা করব। আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তবে একটা জিনিস শুধু খেয়াল করবেন, বিনা দোষে যেন কাউকে হয়রানি না করা হয়। যে সকল ভাইয়েরা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন তাদের নামটি যেন অপব্যবহার না হয়।

গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে না ঘটলেও কাল্পনিক কাহিনি সাজিয়ে অসংখ্য মামলা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হতো। এসব মামলা গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গায়েবি মামলার বাদীরা ছিল হয় পুলিশ, নয়তো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।


সর্বশেষ সংবাদ