বেকার হওয়ার শঙ্কায় বঙ্গবাজারের ৫০ হাজার শ্রমিক

কাজ হারানোর শঙ্কায় বঙ্গবাজারের ৫০ হাজার শ্রমিক
কাজ হারানোর শঙ্কায় বঙ্গবাজারের ৫০ হাজার শ্রমিক  © সংগৃহীত

মাত্র সাড়ে ৬ ঘণ্টার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেট। এ ঘটনায় মার্কেটটির প্রায় ৫ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক হাজার ব্যবসায়ী সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। আর এসব মার্কেটে কর্মরত অর্ধ লাখ কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ার এবং বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশ।

আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবাজার আদর্শ মার্কেটের আগুন দাউদাউ করে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। পর্যায়ক্রমে তা এনেক্সকো, ইসলামিয়া মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ছিল। পুরোপুরি ভস্মীভূত হয় বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট। পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় আগুনে।

আগুনের ঘটনার পরপরই নিরাপত্তার অংশ হিসেবে হাই কোর্ট থেকে গুলিস্তান এবং বঙ্গবাজারসংলগ্ন সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যান চলাচল বন্ধ করা হয় গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়া, নাজিরাবাজার, আনন্দবাজার সড়ক থেকেও। সকালে ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের কাউকে কাউকে মরিয়া হয়ে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। কাঁদছিলেন তাদের অনেকেই।

রিয়াজুল গার্মেন্টস, খান ফ্যাশন, এস এ গার্মেন্টস, খান শাড়ি বিতানসহ বঙ্গ-মার্কেটে ৫টি দোকান ছিল ব্যবসায়ী মো. মামুনের। ঈদকে সামনে রেখে ৫টি দোকানে ১০ কোটি টাকার মালামাল তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু আগুনে এক নিমেষে সব শেষ হয়ে গেছে।

মুহূর্তের মধ্যে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়া এ ব্যবসায়ী কাঁদছিলেন আগুন থেকে বাচাঁতে পারা অল্পকিছু মালামালের ওপর বসে। তিনি জানান, ১০ কোটির টাকার পণ্যের মধ্যে ১ কোটি টাকার মতো বিক্রি করতে পেরেছেন গত কিছুদিন। বাকি পুরো মালামাল দোকান ও গুদামে ছিল। এরমধ্যে মাত্র কয়েক লাখ টাকার মালামাল রক্ষা করতে পেরেছেন। বাকি সব মাল পুড়ে গেছে।

ব্যবসায়ী মামুন বলেন, ‘আমার জীবনের সব উপার্জন যে আগুনে পুড়ে গেল, এই ক্ষতির দায় নেবে কে? কে আমার ঋণ পরিশোধ করবে? আমার তো কিছুই নেই। সব তো শেষ হয়ে গেছে।’

আরও পড়ুন: দুই কোটি টাকার মালামাল ছাই হয়ে যাচ্ছে এক ব্যবসায়ীর

অগ্নিকান্ডের স্থলে ছুটে আসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দীন আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ সরকারের অনেক দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

বঙ্গবাজার মার্কেটে ‘মায়ের দোয়া' নামে ৬টি দোকান ছিল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হেলাল খানের। তার দাবি, এসব দোকানে ৬ কোটি টাকারও বেশি মালামাল ছিল। কোনো রকমে একটি দোকানের মালামাল বের করতে পেরেছেন। গোডাউনের মালামাল বের করতে পারেননি। কিছু পুড়েছে, বাকি সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।

হেলাল খান জানান, ‘ঈদ উপলক্ষ্যে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকার মালমাল তুলেছি। সব নষ্ট হয়ে গেল। এখন সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, তাহলে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াতে পারব। নয়তো আমাদের মরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

ব্যবসায়ী মামুন, হেলাল খানের মতো হাজারও ব্যবসায়ীর দোকান পুড়ে গেছে আগুনে। তাদের মতো সবাই মার্কেটের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের সীমনাপ্রচীর ঘেঁষা সড়কের ফুটপাতে বসে কান্না করছিলেন। কেউ কেউ আগুন লাগার ঘটনা মোবাইল ফোনে পরিবার-পরিজনকে জানাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মতো কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে অনেক কর্মচারীকেও। তারা বলছেন, মালিকদের কাছে তো গত কয়েক রোজার বেচা-বিক্রির কিছু টাকা হলেও আছে। সেটা দিয়ে কিছুদিন হলেও চলতে পারবে। কিন্তু যারা কর্মচারী তাদের হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই। তারা কীভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলবে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলের পাশে ফুটপাতে কথা হয় শিল্পী ফ্যাশন নামে একটি দোকানের কর্মচারী জাকির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেটগুলোতে লাখের ওপরে কর্মচারী রয়েছে। অধিকাংশ দোকানের কর্মচারী গত মাসের বেতনও পায়নি। এর মধ্যে আগুনে সব পুড়ে গেছে। এখন মালিক কবে গত মাসের বেতন দেবে সেটাও জানি না।

জাকিরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি দোকানের কর্মচারী হেলাল বলেন, মালিকরা তো আগুনের ঘটনা দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে। সরকারও তাদের সহযোগিতা করবে। কিন্তু আমরা তো সেটা পারব না। মালিক বেতন না দিলে তো কিছু করার নেই। মালিক যদি বলেন, আগুনে সবকিছু পুড়ে গেছে, কীভাবে বেতন দেবো, তখন আমরা কি করব। আবার এখন তো কোথাও চাকরিও পাব না।

ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা ছিলো। প্রধান বাধা ছিল উৎসুক জনতা। পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে। আর ঘটনাস্থলে অনেক বাতাস ছিল। বাতাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আগুন চলে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ