দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

একবেলা খাবার বন্ধ করেছেন ৫১.৫% শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থী

এক বেলা খাবার বন্ধ করে দিয়েছেন ৫১.৫% শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থী
এক বেলা খাবার বন্ধ করে দিয়েছেন ৫১.৫% শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থী  © সম্পাদিত

দেশে চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে এক বেলার খাবার গ্রহণ বন্ধ করেছেন শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থীদের ৫১.৫ শতাংশ। আর খাবার গ্রহণে মান অথবা পরিমাণে ছাড় দিয়েছেন ৩৮ শতাংশ, দুপুরের খাবার বাদ দিয়েছেন ৭.৫ শতাংশ এবং রাতের খাবার গ্রহণ করতে পারছেন না ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী-চাকরি প্রত্যাশী বা বেকার তরুণরা। শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থীরা জানিয়েছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছেন চলমান সংকটের কারণে। আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে প্রভাব পড়বে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এবং দেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যে। তা-ই সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।

শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, গত কয়েক মাসে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। যার প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। কোনোরকমে জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে খরচ কমাতে খাবার ও পরিবহন ব্যয় সংকুচিত করছেন তারা। কেউ কেউ সকালের অথবা রাতের খাবার কমিয়ে দিয়েছেন। গাড়ি অথবা রিকশার বদলে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। তাছাড়া, এই বছরে মেস ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, প্রতিষ্ঠানের খরচেও যুক্ত হয়েছে বাড়তি ব্যয়। সবমিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

আরও পড়ুন: তরুণদের হতাশার বৃত্ত ভাঙ্গবে কী?

পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েকমাসে বহির্বিশ্বে অস্থিরতা, ডলার সংকট, এলসি খুলতে না পারা, ব্যয়বহুল খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনা, বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের খুচরা বাজারে নিত্য-পণ্যের দাম আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে।

শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থার বাস্তব চিত্র পাওয়া গেছে বাজারের দর-দামে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রকাশিত ঢাকা মহানগরীতে গতকাল সোমবারের (২০ মার্চ) খুচরা বাজার দরের তালিকা অনুযায়ী, পাম অয়েল (খোলা), আমদানি করা দেশী পিয়াজ, দেশী আদা, জিরা, লবঙ্গ, এলাচ, ব্রয়লার মুরগীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আসন্ন রোজার আগেই আরও একদফা এসব পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনাও দেখা গেছে বাজারে।

টিসিবির তথ্য বলছে, প্রতি কেজি সরু নাজির-শাইল বা সরু মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা কেজি, পাইজাম ও মোটা স্বর্ণা, চায়না চাল বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৬ টাকা কেজি। ভোজ্য তেলের মধ্যে সয়াবিন তেল (খোলা) প্রতিলিটার ১৬৮ টাকা, সয়াবিন তেল (বোতল) ৫ লিটার ৮৭০ টাকা, সয়াবিন তেল (বোতল) ১লিটার ১৮০ টাকা, পাম অয়েল (খোলা) প্রতি লিটার ১২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও চাকরিতে এখনও পিছিয়ে নারীরা

সর্বশেষ বাজারে মাছ ও মাংসের মধ্যে রুই মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকায়, ইলিশ মাছ প্রতি কেজি ৬০০ টাকায়, গরুর মাংস কেজি প্রতি ৭২০ টাকায়, খাসির মাংস প্রতি কেজি ১ হাজার টাকায়, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ২৪০ টাকায় এবং দেশি মুরগি প্রতি কেজি ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য পণ্যের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বাজার দর তো তালিকায় রয়েছেই।

জরিপের প্রাপ্ত ফলাফল বলছে, ৫১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের সকালের নাস্তা বা খাবার বাদ দিয়েছে এবং খাবার তালিকায় কাটছাঁটের হিসেবে এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থীর মতামত। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা এরপরেই ছাড় দিচ্ছেন তাদের খাবারের মানে এবং পরিমাণে। তারা বলছেন, আগে যেখানে ২০-৪০ টাকার মধ্যে তারা একটি ভালো খাবার বা নাস্তা পেতেন, এখন তা পেতে হলে তাদের খরচ করতে হয় দেড় বা দ্বিগুণ অর্থ। ফলে, তারা সমাধান হিসেবে কম দামের বা মানের খাবার গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন।

এছাড়াও শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সংকটের কারণে তাদের ছাড় দিতে হচ্ছে দুপুরের খাবারেও। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক তাদের এমন মতামত জানিয়েছেন। এছাড়াও, রাতের খাবার বা দিনের কোন এক বেলার খাবার বাদ বা ছাড় দিচ্ছেন দেশের শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থীরা; সংখ্যার হিসেবে এ হার ৭.৫ ও ৮ শতাংশ।

জরিপ চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী তাদের এ অবস্থার কথা জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা: মেধা আর অর্থ দুটোরই অপচয়

এ নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের একজন আবাসিক শিক্ষার্থীর সাথে। তিনি তার নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান; মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা বড় সমস্যা হলো, তারা না বলতে পারে, আবার না সহ্য করতে পারে। আমি যখন ২০২২ সালে  বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি তখন দ্রব্যমূল্য কিছুটা কম ছিল। যার ফলে একটা টিউশনি করে মোটামুটি পুরো মাস সুন্দরভাবে চলানো যেত। কিন্তু, বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায়; আগে যেটা ১০ টাকা দিয়ে কিনতাম সেটার দাম হয়ে গেছে ১৫ টাকা। যার ফলে এখন খুব টানা-পোড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আগে তিন-বেলা খেতাম, এখন ইচ্ছে করে সকালে রুম থেকে বের হইনা, দুপুরে বের হয়ে খেয়ে নেই। আবার ক্লাস থাকলে সরাসরি ক্লাসে চলে যাই এসে দুপুরে খাই। একজন শিক্ষার্থীর শুধু তিন-বেলা মোটামুটি মানের খাবার খেতেই সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। যা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার অথবা একটিমাত্র টিউশনি করে চালানো অনেক কষ্টকর।

‘‘মধ্যবিত্ত মানের একটি পরিবার হলেও গ্রামে পরিবারসহ খুব ভালোভাবেই আমাদের চলতো। তিনবেলা ভালোমন্দ খেয়ে চলানো যেত। কিন্তু ঢাবিতে আসার পরে সবকিছুর এত দাম বেড়েছে যে তিনবেলা ভালো খাবার তো পরে, নিম্ন বা কোনরকম মানের খাবার খেতে হচ্ছে। খরচ বাঁচাতে মাঝে মাঝে সকালে খাওয়া বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মাছ-মাংস বাদ দিয়ে শাক-সবজি দিকে আমাদের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। এতে আমাদের ক্যালরির ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।’’

এসব খেয়েও অন্যান্য খরচসহ মাসে ৫-৬ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে, যা আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অনেক বেশিই কষ্টের—জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী। তার দাবি শিক্ষার্থীদের পূর্ণ বিকাশ, পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতকরণে হলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ভর্তুকি নিশ্চিত করার।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে দেশের অন্য শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও। এ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের (ডাইনিং) খাবারের মান একবারেই কমে গেছে। আগে যতটুকু মান রাখা হতো এখন তা-ও নেই; তিনি বলছেন, বাইরে খেতে অনেক টাকা লাগে, যা সাধ্যের বাইরে। সকালের নাস্তা মাঝে মাঝে খাওয়া হয়। সত্যি বলতে পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাই, আবার ক্ষুধা নিয়েই ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যাই।

আরও পড়ুন: সরকারিতে বাড়লেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কমেছে বেসরকারিতে

আর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের স্নাতক সম্মান কোর্সের ২য় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তার বাবা একজন কৃষক, তিনি বর্তমানে একটি মেসে থাকছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাকে বর্তামানে এক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। এছাড়াও তিনি খরচ কমাতে সকালে না খেয়েই দুপুরে একবারে খাবার গ্রহণ করছেন। এতে কষ্ট হলেও কাউকে জানাতে পারছেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের উপরই নয় বরং দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, চলমান অবস্থায় আমাদের আয় বাড়েনি; কিন্তু, দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে। ফলে, ন্যূনতম স্বাস্থ্য রক্ষায় শিক্ষার্থীদের যেসব খাবার গ্রহণ করা উচিৎ, তা গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলেন, শিক্ষার্থীদের এ সময় বা বয়সকে একটি উঠতি বয়স হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসময় তাদের পুষ্টিকর এবং সুষম খাবার গ্রহণ করা উচিৎ। কিন্তু, এসময় কম খাবার গ্রহণ বা খাবার গ্রহণ না করার ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অভাবে তাদের ভালো ঘুম হয় না বা ঘুম কম হয়। আর ভালো ঘুম না হলে তারা ভালো পড়াশোনা করতে পারে না। 

শিক্ষার্থীদের চলমান সমস্যা সমাধানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের খাবারের মান বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ বা ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে পারে। সামগ্রিক বিচারে যেহেতু আমাদের সবার উপরই এর প্রভাব পড়ছে সেহেতু সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সাজাতে হবে—যুক্ত করেন অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা।


সর্বশেষ সংবাদ