নিপীড়িত মানুষের অনন্য কণ্ঠস্বর নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো

স্বকৃত নোমান
স্বকৃত নোমান  © টিডিসি সম্পাদিত

সম্প্রতি প্রয়াত হলেন কিংবদন্তিতুল্য আফ্রিকান সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। দীর্ঘ ষাট বছরেরও বেশি সময়জুড়ে তার বিস্তৃত সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি চিত্রিত করেছেন কেনিয়ার পরিবর্তনের ইতিহাস, উপনিবেশ থেকে গণতন্ত্রে রূপ নেওয়ার কঠিন যাত্রা। তার বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘আ গ্রেন অব হুইট’ বা ‘গমের দানা’ দাগ কেটেছিল হৃদয়ে। উপন্যাসটির কুড়ি পাতা পড়ার পর চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে বিশাল এক ভূখণ্ড, যেখানে হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ লড়ছে। দেখতে পাই অসংখ্য মানুষের রক্তস্রোত, নিপীড়ন আর প্রতারণার তীব্র দহন। ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকি কেনিয়ার স্বাধীনতা লাভের সকরুণ প্রেক্ষাপটের এই মহান শিল্পকর্মের গভীর থেকে গভীরে। 

আফ্রিকার জাতিভেদ ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আরবদের গোত্রপ্রীতি থেকেও ভয়ংকর। সেই জটিলতা আঁকতে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তার উপন্যাসে আশ্রয় নিয়েছেন এমন সব ঘটনার, গল্পচ্ছলে যা সামাজিক প্রথার ভিত্তি ও রং চিনতে সাহায্য করে। কাহিনির কোথাও তিনি টেনে এনেছেন নবি মুসাকে, আর কোথাও প্রতীকী যিশুকে। এক আশ্চর্য বিপন্নতা ও বিদ্রোহ এই উপন্যাসের পরতে পরতে গুমরে গুমরে কাঁদে। কেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নায়ক জুমু কেনিয়াত্তা হিমালয়ের মতো বিশাল ও অস্পষ্ট ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মঞ্চের পেছনেই। 

উপনিবেশের কুফলে কেনিয়ার বিভক্ত জাতি, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বার্থের সংঘাতে ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস ও দ্বিধার বর্ণনায় উজ্জ্বল এই শিল্পকর্মের গভীরে সাঁতার কাটতে কাটতে পরিচিত হই কিহিকার সঙ্গে; মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়ে যে হারিয়ে যায় গেরিলা জঙ্গলে। পরিচিত হই অনাথ মুগোর সঙ্গে, যে মুক্তিযোদ্ধা ও বন্ধু কিহিকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মুগো চরিত্রটি কি লেখকেরই প্রতিরূপ? কে জানে, হতেও পারে। আর গিকোনিও? স্ত্রী মুম্বি আর বৃদ্ধ মাকে একা ফেলে বিপ্লবীদের সমর্থনে বন্দিত্ব বরণ করে নেয় গিকোনিও।

আহা জেনারেল আয়ের! একটা স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য তিনি লড়াই চালিয়ে গেলেন, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে কাঁচা মাংস খেয়ে সময় পার করে দিলেন। পরিচিত হই উপন্যাসের আরেক চরিত্র কারাঞ্জার সঙ্গে। পার্টি আর মুক্তিযুদ্ধের শপথ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সে ইংরেজ সরকারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল শুধু প্রেমিকা মুম্বির কাছে থাকার জন্য। শুধু মুম্বিকেই ভালোবাসে সে, মুম্মিকেই চায়, শুধু মুম্বিকে পাওয়ার জন্য ক্যাম্প আর জঙ্গল থেকে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে চলে। শুধু মুম্বিকে কাছে পাওয়ার জন্যই সে বেছে নেয় ব্রিটিশদের আনুগত্য, গোলামি।

কিন্তু মুম্বির স্বামী গিকিনিও? ব্রিটিশদের ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বিধ্বস্ত গিকিনিও ফিরে এসে দেখে তার স্ত্রী মুম্বির কোলে শিশুসন্তান! সেই সন্তান তার ঔরসজাত নয়। তবে কার? কেন, কারাঞ্জার! মুম্বি ধরেই নিয়েছিল ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে তার স্বামী আর কোনোদিন ফিরবে না। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তবু মুম্বি আশায় থাকে একদিন তার স্বামী নিশ্চয়ই ফিরবে। দিনের পর দিন উপোস থাকতে থাকতে যখন প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল মুম্বি, তখন কারাঞ্জাই সামান্য খাবার দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তুলেছিল।

না, শুধু এই জন্য সে কারাঞ্জার শয্যাসঙ্গিনী হয়নি, হয়েছে অন্য কারণে। যেদিন কারাঞ্জা তাকে জানাল ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে গিকিনিও ফিরে আসছে, সেদিন কী যে হলো মুম্বির, যেন সে পাগল হয়ে গিয়েছিল, আনন্দে সে পাগলের মতো হাসতে শুরু করল। সত্যি যেন সে পাগল হয়ে গেল। তার ঐ অসতর্ক মুহূর্তে কারাঞ্জা তার ঠান্ডা ঠোঁট ছোঁয়াল মুম্বির ঠোঁটে। মুম্বি বাধা দিল না। বাধা দেয়ার মতো কোনো শক্তিই তার ছিল না। কে জানে, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো হয়তো নিজের প্রতিপক্ষেই সুন্দরী, অভিমানী কিন্তু কঠোর এই মুম্বিকে এঁকেছেন অনমনীয় দৃঢ়তায়; আবেগি হয়েও যে নির্দয়। 

এত কিছুর পরও উপন্যাসের শেষ পর্বে উহুরু বা স্বাধীনতা উৎসবে হাত ভেঙে ফেলা গিকোনিও হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শুয়ে শেষ পর্যন্ত স্ত্রী মুম্বির জন্য একটি টুল বানানোর কথা ভাবে। কাঠ খোদাই করে সে বানাবে টুলটি। সে খোদাই করে তুলবে একটা রোগা মানুষ, যার মুখে কঠিন সংকল্প, যার কাঁধ আর মাথাটা ঝুঁকে থাকবে আসনের বোঝাটা বইবার জন্য। মানুষটা ডান হাত বাড়িয়ে ধরে থাকবে একটা নারীকে। নারীটির মুখেও থাকবে কঠিন সংকল্প। তৃতীয় মূর্তিটা হবে একটি শিশুর। তার কাঁধে এবং মাথায় এসে নারীটির আর পুরুষটির হাত দুটো মিলিত হবে। তার মানে মুম্বিকে স্বীকার করে নিলো গিকোনিও? মুম্বির ‘অবৈধ’ সন্তানটিকেও স্বীকার করে নিলো? কী অদ্ভুত শিল্পীত কায়দায় গিকোনিও আর মুম্বির মিলনদৃশ্য আঁকলেন নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো! একেই বলে প্রকৃত কথাশিল্পী, একেই বলে প্রকৃত কথাশিল্প।

কিহিকা, কারাঞ্জা, মুগো, গিকোনিউ এবং মুম্বি...নেয়ার মাউ-মাউ বিপ্লবের শেষ পর্বে, স্বাধীনতার ক্রান্তিলগ্নে, এই পাঁচ চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশ ও বিকাশই ‘আ গ্রেন অব হুইট’কে করে তুলেছে মহিমান্বিত। ‘আজকের সমাজ বাস্তবতায় সুবিধাভোগীরাই জয়ী’―এই তিক্ত সত্যকেই বুঝি এপিকধর্মী এ কাহিনির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নগুগি। বঞ্চনা, নিপীড়ন ও আত্মত্যাগের নিঃশেষিত ও পরাজিত মুক্তিসেনাদের জীবন পড়তে পড়তে বুকের ভেতরে এক সকরুণ বিলাপ ঘুর্ণিবায়ুর মতো ঘুরতে থাকে কেবল। জীবন এত নিষ্ঠুর, এত রূঢ়, এত নির্মম!

৮৭ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। বলা যেতে পারে দীর্ঘ জীবন। ‘আ গ্রেন অব হুইট’ এবং ‘দ্য রিভার বিটুইন’ উপন্যাস দুটির জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তর। হাজার বছর আফ্রিকার জনগোষ্ঠী তাকে করবে নমস্কার। তার অন্তিম যাত্রায় আমরাও তাকে নমস্কার করি।


সর্বশেষ সংবাদ