স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় জেন্ডার আর ধর্ম ঘরটা থাকা কি জরুরি?

মোজাফ্ফর হোসেন
মোজাফ্ফর হোসেন  © টিডিসি সম্পাদিত

কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থে আছে, পুরুষের শরীর থেকে নারীর সৃষ্টি। ভাষাতে আবার সেই চিহ্নটা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর সব চেয়ে গ্রহণযোগ্য ভাষা ইংরেজি, সেখানে দেখেন Man হলো পুরুষ, Woman হলো নারী। অর্থাৎ Wo+man। আবার female শব্দের মধ্যেও male (পুরুষ) আছে। গোটা মানবজাতিকে বলা হয় Human/Mankind, এখানেও Man আছে। আবার দেখেন আমরা যখন pronoun করি, he হলো পুরুষ, she হলো নারী। অর্থাৎ s+he, এখানেও নারীর শরীরে পুরুষের শরীর ঢুকে গেছে। অর্থাৎ যেন নারীর পুরুষ ছাড়া স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, পুরুষের আছে। বাংলা ভাষায় দেখেন, বিপরীত শব্দ যখন শিখি, তখন বলা হয়, ‘নর-নারী’। ‘নারী-নর’ কোথাও লেখা হয় না। মানে নরের সৃষ্টি আগে এবং ‘নর’ থেকে ’নারী’র সৃষ্টি। তেমনি ‘পতি-পত্নী’। কোনো বইতে ‘পত্নী-পতি’ লেখা পাবেন না। প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এইভাবে ভাগ করা হয়েছে, ‘বাঘ-বাঘিনী’। যেন অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও আদমের মতো পুরুষ প্রাণীকে আগে সৃষ্টি করা হয়েছে, ইভের মতো বাঘিনীকে।

আরও পড়ুন: আবেগ নয়, সময় ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী আইনের সংস্কার হওয়া উচিত

সম্ভবত পৃথিবীর সকল ভাষাতে এই চরিত্রটা লক্ষ্য করা যাবে। অনেক সময় অনুবাদে একভাষার ক্লীব শব্দ অন্যভাষায় পুরুষবাদী হয়ে গেছে। যেমন: President শব্দের জেন্ডার হয় না। বাংলায় ‘সভাপতি’ করে শব্দটাকে খতনা দিয়ে পুরুষ করা হলো। তেমনি First person-কে করা হলো ’প্রথম পুরুষ' বা 'উত্তম পুরুষ'! প্রথমত পারসন মানে শুধু পুরুষ না, আর উত্তম/অধমেরও বিষয় এটা এটা। গতকাল একটা বইয়ে পড়লাম, `তিন পুরুষ ধরে পরিবারটি শিক্ষিত'। ওই পরিবারে কি নারী নাই? `তিন প্রজন্ম ধরে...' লিখলে অসুবিধা কোথায়? 

এরকম শতশত উদাহরণ দেওয়া যাবে।  এগুলো আপনাদের অজানা না। কিন্তু আসছি আমার মূল পয়েন্টে। কিছুদিন থেকে দেখছি, কিছু কিছু শব্দের জেন্ডার পরিচয় তুলে দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক নারীপুরুষ সকলে সেটা সানন্দে গ্রহণও করছেন। খুবই ভালো কথা। কিন্তু লক্ষ্য করবেন, এখানেও একটা রাজনীতি আছে।

বলা হচ্ছে ‘লেখিকা’ আর না, নারী হোক পুরুষ হোক ’লেখক’। তেমনি ‘অধ্যাপিকা’ না ‘অধ্যাপক’। ‘অভিনেত্রী’ না, ‘অভিনেতা’। ইংরেজিতেও Actress না, Actor। ’সভানেত্রী’ আর না, নারী হোক পুরুষ হোক ’সভাপতি’। ‘ম্যাডাম’ না, ’স্যার’। 

পেশাগত পরিচয়ের জেন্ডার থাকা উচিত না। আমার প্রত্যাশা ভাষা যতটা সম্ভব জেন্ডার নিরপেক্ষ হোক। কিন্তু তাই বলে সকল পুরুষবাচক শব্দ থাকবে, নারীবাচক শব্দগুলো বিলুপ্ত হবে, এবং নারীর ওপর পুরুষবাচক শব্দগুলো চাপিয়ে দেওয়া হবে, সেটাও একটা পলিটিক্সের অংশ। কোথাও দেখবেন না নারীপরিচয়ের সঙ্গে পুরুষ পরিচয় মিশছে। মানে বলা হচ্ছে না, আজ থেকে শিক্ষক হবে না, নারীপুরুষ সকলে ‘শিক্ষিকা’। কিংবা ’শিক্ষক’ ও ‘শিক্ষিকা’ ফেলে তৃতীয় কোনো শব্দ তৈরি করা হচ্ছে না।

প্রশ্ন হলো, একজন নারী ‘লেখক’ নাকি ‘লেখিকা’? এখন অনেকে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে ‘লেখক’ ব্যবহার করছে। নারীরাও নিজেদের লেখিকা নয়, লেখক পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু এই চিন্তা কি কারো মাথায় এসেছে যে, নারীপুরুষ উভয়েই লেখিকা। লেখক বলে কিছু থাকবে না। একটা জায়গাতেও কি এরকম ‘কম্প্রোমাইজ’ পুরুষ করেছে? নারী কেন করছে? 
একটু বেঁকে চিন্তা করলে, একজন নারী যখন সভাপ্রধান হন, তখন পুরুষ সদস্যরা নিজেদের সভানেত্রীর (পড়ুন নারীর) অধীনে ভাবতে অস্বস্তি বোধ করেন, এই কারণে তারা সভাপতি (মানে পুরুষ পদ) রাখতে চান। যেমন উচ্চপদস্থন নারীকে ম্যাডাম না ডেকে স্যার ডাকেন, মানে শব্দের মধ্যে পুরুষের প্রতিনিধিত্ব জিইয়ে রেখেও একধরনের শান্তি।

আমি নারীদের লেখিকা বলি না, বা লিখি না। নারী-পুরুষ উভয়কেই লেখক বলি/লিখি। কিন্তু কেন? লেখক কি জেন্ডার নিরপেক্ষ শব্দ? যদি একটা পক্ষ নিতেই হয় তাহলে, নারী-নারী-পুরুষ উভয়কেই আমি লেখিকা বলি না কেন?
আজ হঠাৎই প্রশ্নটা মাথায় আসো।

আরও পড়ুন: ফেসবুকে মত প্রকাশ, শিক্ষিকা লাকী খাতুনকে কেন হয়রানি করা হবে?

প্রশ্নটাকে আমি হালকা করে দেখছি না। আমি বিশ্বাস করি: if you control language, you control everything. পুরুষ সমাজের ভাষা নির্ধারণের মাধ্যমে নারীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ভাষা-রাজনীতির কারণে আমরা প্রকৃতিগত ভাবে মেনে নিই, চাঁদ নারী, সূর্য নর। এই এলিগরি থেকে আমরা সার্বিকভাবে মেনে নিই যা নরম তাই নারী আর যা বলিষ্ঠ তাই পুরুষ। কারণ আমরা ভাষা আবিষ্কার করি না বরং মানুষ ভাষার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করি। আর সে কারণেই, কেউ যদি বলে, আমি রাস্তায় একজন মানুষকে যেতে দেখলাম। আমরা বুঝি সে কোনো পুরুষকে যেতে দেখেছে; কেননা নারীকে দেখলে বলতো, আমি রাস্তায় একটা মহিলাকে যেতে দেখলাম। কেন বলতো? সংবাদের শিরোনাম করা হয়: ‘নারী ও শিশুসহ আটক ১৩’; মানে পুরুষও আছে। তাহলে শুধু পুরুষ বাদ দিয়ে ‘নারী ও শিশুসহ’ বলার কারণ কি? কিংবা ‘শিশুসহ আটক ১৩’ বললেই তো হয়। শিশু আলাদা হতে পারে। কিন্তু নারীপুরুষ আলাদা করা কেন?

আজ একটি খবরের হেডলাইন: ‘নারীসহ নিহত দুই’, তার মানে অপর নিহতজন হলেন পুরুষ। নিহত হয়েছে দুজন ‘মানুষ’ সেখানেও বিভাজন? নারীকে আলাদা করা কেন? কিংবা পুরুষসহ নিহত দুই বললেও তো বোঝা যায় অপরজন নারী, সেটা কেন নয়? বা শুধু ‘নিহত দুই’ বললে সমস্যা কোথায়?

আমি যেটা বুঝি, অকারণে জেন্ডার আলাদা করা যাবে না। করলে পুরুষকেও আলাদা করতে হবে। যদি বলি: ‘বাংলাদেশ নারী মহিলা ক্রিকেট দল’; তাহলে বলতে হবে ‘বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট দল’। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বলতে পুরুষ দল বোঝাবে আর নারীদের বোঝাতে আলাদা করে ‘নারী’ শব্দটি লাগাতে হবে, এই বিধান জেন্ডারবৈষম্যকে স্বীকৃতি দেয়।

আমি তো স্কুল কলেজে ভর্তি, চাকরির সময় জেন্ডার আর ধর্ম ঘরটাই তুলে দেওয়ার পক্ষে। ভেবে দেখেন, এনআইডি কার্ডে কোনো মানুষের ধর্ম, জেন্ডার উল্লেখ নেই। তাতে কি বিরাট অসুবিধা হবে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক


সর্বশেষ সংবাদ