তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে স্বাধীনতা

স্বাধীনতা মানে শুধু অতীতের বিজয়গাথা নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য এক অমলিন অনুপ্রেরণা। তরুণদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা কেবল ভৌগোলিক মুক্তির গল্প নয়, বরং নিজেদের চিন্তা, স্বপ্ন আর দেশ গড়ার দায়িত্বের নাম। আজকের শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করছে, কোন স্বপ্ন তারা বাস্তবায়ন করতে চায় সেই ভাবনাগুলো জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের কথাগুলো শুনেছেন করেছেন— তানজিদ শুভ্র।
স্বাধীনতা আমাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করে
২৬ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। একটি জাতির স্বাধীনতা শুধু রক্তাক্ত ইতিহাস নয় হাজারো স্বজনহারা পরিবারের আর্তনাদ, আত্মত্যাগ, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। স্বাধীনতা একটি জাতিকে উপহার দেয় বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, গ্লানি, শাসন ও শোষণ, থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল বাঙালি জাতি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা গৌরবের, অহংকারের পবিত্রতম একটি দিন। এই দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যাদের আত্মত্যাগে আমরা স্বাধীন।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও কিছু কুচক্রী মহল আমাদের স্বাধীনতার গৌরবকে কলঙ্কিত করতে চায়। যারা স্বাধীনতার গৌরবকে কলুষিত করতে রাহাজানি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত।
যেসব অপশক্তি আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে চায় তাদের সমূলে উৎখাত করতে হবে। সব ধরনের অপশক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল সাধারণ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার গৌরবকে আরো বেশি শানিত করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার মাহাত্ম্য তুলে ধরতে হবে।
নাইমা খাতুন
শিক্ষার্থী, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ।
স্বাধীনতা শুধু স্মৃতি নয়, এটি উন্নয়নের অনুপ্রেরণা
স্বাধীনতা কোনো নিছক স্মৃতিচারণ নয়; এটি আমাদের জাতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি। একটি জাতির প্রকৃত মুক্তি তখনই অর্জিত হয়, যখন সেই স্বাধীনতার সুফল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। আমাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে লাখো মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। তবে, এই অর্জন তখনই সার্থক হবে, যদি আমরা একটি সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক এবং টেকসই উন্নয়নশীল দেশ গড়ে তুলতে পারি।
স্বাধীনতার প্রকৃত আদর্শ হলো আত্মনির্ভরশীলতা, সুশাসন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। যদি আমরা শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকি, তবে স্বাধীনতার প্রকৃত লক্ষ্য পূর্ণ হবে না। আমাদের উচিত এই চেতনা থেকে শক্তি নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি এবং অর্থনীতি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে এবং অবকাঠামোতে উন্নতি হয়েছে। তবে, দুর্নীতি, আয় বৈষম্য, বেকারত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো এখনও রয়েছে। যদি স্বাধীনতার চেতনা আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধকে উদ্দীপ্ত করতে পারে, তবে এসব সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তরুণ সমাজ আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, সৃজনশীল চিন্তা এবং সুশাসনের চেতনাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
মোহাম্মদ নুর হোসেন নয়ন
শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রংপুর।
স্বাধীনতা আমার অস্তিত্বের চিহ্ন
পুরো একটা জাতি তখনই পরিচয় পায়, নিজস্বতার অধিকারী হয় যখন স্বাধীনতা অর্জিত হয়। স্বাধীনতা মানে নিজের ভূখণ্ডের মানুষের সাথে পরম মমতায়, দেশের মাটির গন্ধের সাথে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতির মুক্তির সম্ভাবনা। মানুষের উপর করা জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন থেকে নিষ্পেষণের জন্যই স্বাধীন করতে শহীদরা ছিল একতাবদ্ধ সে দেশ যেনো আমার। যেখানে মানুষ মানুষের জন্য থাকবে। শান্তি আর সমৃদ্ধির জন্য নিবেদিত থাকবে। স্বাধীনতার গল্প থাকবে গেঁথে হৃদয় মাঝে।
নব উত্থানে হোক বীরদের কথা। কার্পণ্য যেমন করেনি প্রাণ দিতে বীর সন্তানেরা। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছে, বাঁচতে শিখিয়েছে নতুন ভাবে। আমি কে? আমার পরিচয় কী? জেনেছি স্বাধীনতার কারণে। স্বাধীনতার শক্তি ছড়িয়ে পড়ুক। স্বাধীন দেশে নৈরাজ্যের সৃষ্টি কাম্য নয়। স্বাধীনতা লাভের আত্নগরিমায় গৌরবান্বিত হয়ে উঠুক বাঙালি। প্রত্যেকের নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বাধীন চেতনা রক্ষা করতে হবে। বদ্ধপরিকর হোক ভাবনাগুলো।
সুরাইয়া ইয়াসমিন সুমি
শিক্ষার্থী, সরকারি বি. এল কলেজ, খুলনা।
ভবিষ্যৎ চিন্তা ভাবনা করা অযৌক্তিক
পরের অধীনতা হতে মুক্তির স্বাদের আস্বাদন করাই স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এখনো পরাধীন। ইতিহাসে স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা লিখা থাকলেও তা সঠিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময় স্বাধীনতার গল্প ও শক্তি সম্পর্কে আমাদের উৎসাহিত করার প্রাণান্তর প্রচেষ্টা করা হলেও আজ তা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ভবিষ্যতে জনতার স্বাধীন চেতনা যাতে উজ্জীবিত থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। মৌখিক উপায়ে সবাই স্বাধীনতার কথা বলে কিন্তু স্বাধীনতা কোথায়? বাংলাদেশটাই স্বাধীন হয়েছে মানুষের মনের স্বাধীনতা এখনো অর্জন হয়নি।
যারাই আসেন তাঁরাই কিছুদিন যেতে না যেতেই শোষণের প্রক্রিয়ার শাসক হয়ে উঠেন। পূর্বের চেয়ে কীভাবে বেশী শোষণ করা যায় সে উপায় খুঁজে নেয়! স্বাধীনতা বাহ্যিকভাবে অর্জিত হলেও বাংলাদেশের মানুষ আজও পরাধীন। শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরিসহ সার্বিকদিক বিবেচনা করে প্রতিটি স্তরেই শোষণ নিপীড়নের শিকার যেখানে ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা করা অযৌক্তিক।
ইকরাম আকাশ
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ।
স্বাধীনতা মানে কী?
স্বাধীনতা মানে মুক্ত বিহঙ্গে উড়ে বেড়ানো। বাংলাদেশ স্বাধীনতার এত বছর হলেও আমরা প্রকৃত স্বাধীন কিনা সে চিন্তা মাথায় ঘোরে। স্বাধীনতা মানে মুক্ত চিন্তা, মুক্ত মত, মুক্ত চলাফেরা। সর্বক্ষেত্রে নিজস্ব মতামত প্রদান করাই স্বাধীনতা। একটি দেশের নাগরিক যখন নিজ চেতনায় বেড়ে উঠবে কিংবা দেশের উন্নয়নের লক্ষ্য অভিমত প্রকাশ করবে তখনই দেশ ও দেশের মানুষ প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন। তরুণ প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা মানে বইয়ের পাতা পড়ে বুলি আওড়ানো নয়, ভবিষ্যৎ গড়ার শক্তি। কীভাবে একটি সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা দেশ গড়া যায় সে লক্ষ্য মত প্রকাশ ও কাজ করা।
জাতি-ধর্ম-বর্ণলয় দেশের উন্নয়নের লক্ষ্য ব্যক্তি স্বার্থ না হয়ে মানবসেবা পরম ধর্ম ধারণ করা। নিজ দেশের একতা দেখে অন্য দেশ যাতে বলতে পারে দেশটি প্রকৃত স্বাধীন। তরুণদের মনে সবসময় আশার আলো জাগ্রত করতে হবে। তুমি পারবে, তোমাকে পারতে হবে তোমার দেশের জন্য। তাই দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য স্বাধীনতা সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন জরুরি।
খাদিজা আক্তার সায়মা,
শিক্ষার্থী, সরকারি তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ।
স্বাধীনতার মানে ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা করা
স্বাধীনতা আমার কাছে শুধু একটি ঐতিহাসিক অর্জন নয়, এটি আমাদের দায়িত্ববোধ এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক। আমরা মুক্ত দেশ পেয়েছি, কিন্তু সত্যিকার স্বাধীনতা তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ সমান সুযোগ পাবে, বৈষম্য দূর হবে, এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হবে। তরুণ প্রজন্ম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব শুধু নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়া নয়— বরং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অংশীদার হওয়া।
শিক্ষা, প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা আর নৈতিকতার আলোয় বাংলাদেশকে গড়ে তোলাই আমাদের নতুন যুদ্ধ। স্বাধীনতার মানে আমার কাছে অন্যকে দোষারোপ করা নয়, বরং নিজের জায়গা থেকে ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা করা। আমরা যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চাই, তাহলে নিজেদের বদলানো, সচেতন হওয়া, আর একে অপরের পাশে দাঁড়ানোই হবে স্বাধীনতার প্রকৃত সম্মান।
উম্মে সালমা
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ।