সভাপতি-সুপারের নানা অনিয়ম

মাদ্রাসায় না এসেই ১২ বছর ধরে বেতন নেন সভাপতির ভাগ্নি

দূর্গাপুর হাজী মোবারক আলী দাখিল মাদ্রাসা সভাপতি আসাদুজ্জামান লিটন ও মাদ্রাসা সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেন
দূর্গাপুর হাজী মোবারক আলী দাখিল মাদ্রাসা সভাপতি আসাদুজ্জামান লিটন ও মাদ্রাসা সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেন  © ফাইল ছবি

নিয়োগে অনিয়ম, অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ, জোর করে সভাপতির পদ ১২ বছর ধরে বাগিয়ে রাখা, যোগসাজশে এমন নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে বরিশাল সদর উপজেলার ৮নং চাঁদপুরা ইউনিয়নের ‘দূর্গাপুর হাজী মোবারক আলী দাখিল মাদ্রাসাটি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে অনুপস্থিত থেকেও মাদ্রাসা সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেনের মাধ্যমে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে টানা ১২ বছর ধরে বেতন তুলছেন সিনিয়র শিক্ষিকা নাহিদা আক্তার। হাজিরা খাতায় তার নামে কয়েকদিন পর পর একসঙ্গে স্বাক্ষর করেন মাদ্রাসার সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেন। সিনিয়র শিক্ষিকা নাহিদা আক্তারের নাম নেই প্রতিষ্ঠানটির ক্লাস রুটিনে; তাকে চিনেন না খোদ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। আর এমন নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে মাদ্রাসাটির সভাপতি আসাদুজ্জামান লিটনের সহযোগিতায়। 

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ২০২০ সালে অবৈধ ভাবে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে গোপনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে স্থানীয় তিনজনকে। যাদের দুইজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এবং স্থানীয় হওয়ার কারণে তাদের দ্বারা হয়রানির শিকারও হতে হয় দূরবর্তী জেলার কর্মরত শিক্ষকদের। তারা আবার সঙ্গ দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও সুপারের।

অভিযোগ আছে, মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী মোঃ আনিচুর রহমান প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে না আসায় তাকে শোকজ নোটিশ এবং পরবর্তীতে তার বেতন কেটে রাখা হয়েছে। এছাড়াও তিনি এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই নানা ভাবে হয়রানি, শোকজ ও বেতন কর্তনের ঘটনায় তিনি আদালতে মামলা করেছেন, যা জোর পূর্বক পরবর্তীতে তুলতে বাধ্য করা হয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মৌলভী মোঃ আনিচুর রহমান সকল অভিযোগ নাকচ করেন। যদিও প্রতিবেদকের সাথে তার আলাপকালে তাকে যথেষ্ট ভীত মনে হয়েছে এবং তিনি কথা বলার সময় বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিলেন।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সমাজে শিক্ষার আলো ছড়াতে ১৯৮৫ সালে বরিশাল সদর উপজেলার ৮নং চাঁদপুরা ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামে অবস্থিত এ মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার একবছর পর স্বীকৃতি পেয়ে এমপিওভুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান সভাপতি আসাদুজ্জামান লিটনের পিতা হাজী মোবারক আলীর নিজ জমিতে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে শিক্ষার পরিবর্তে পরিণত হয়েছে একটি লাভজনক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন সময় নিয়োগ-কৃত শিক্ষকদের কাছে থেকে নেয়া হয়েছে মোটা অংকের অর্থ। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মৌলভী মোঃ আনিচুর রহমান, সিনিয়র শিক্ষক মইনউদ্দিন বিশ্বাস, সহকারী সুপার মুনসুর আলীসহ আরও কয়েকজন শিক্ষকের নিয়োগে অভিযোগ আছে অনিয়মের। নানা অনিয়ম দুর্নীতি থাকলেও পরিচালনা পর্ষদ এবং সুপারের বিরুদ্ধে চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে চান না তাদের কেউই।

অনুসন্ধান বলছে, একাধারে ১২ বছর ধরে দূর্গাপুর হাজী মোবারক আলী দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি রয়েছেন আসাদুজ্জামান লিটন। তিনি সভাপতি হওয়ার পর ২০১১ সালে মাদ্রাসায় নিয়োগ হয় তার আপন ভাগ্নি নাহিদা আক্তারের। যিনি কাগজে-কলমে মাদ্রাসায় যোগদান করেন ০২/০৪/২০১১ ইং তারিখে। এখানে যোগদানের আগে তিনি চাকুরী করতেন ভোলার একটি বিদ্যালয়ে। তাকে চিনেন না এখান কার কোনো শিক্ষার্থী এবং তিনি যোগদানের পর থেকেও অনুপস্থিত থাকলেও সরকারি কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন হিসেবে প্রতি মাসে তুলছেন ২৬ হাজার ৭৯০ টাকা। মাদ্রাসার হাজিরা খাতায় তার নামে উপস্থিতির স্বাক্ষর করেন মাদ্রাসার সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেন। একাজের জন্য তিনি অর্থও পান নিয়মিত; প্রতিমাসে হাজিরা বাবদ তিনি নাহিদা আক্তারের কাছ থেকে নেন ৩ হাজার টাকা। যা নাহিদা আক্তার এ প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর ৩শত টাকা থেকে শুরু হয়েছিল এবং এখন তা বাড়তে বাড়তে ৩ হাজারে পৌঁছেছে। প্রতিষ্ঠানটির রুটিন, হাজিরা খাতায় সুপারের একাধিক স্বাক্ষরসহ নানা অনিয়মের কপি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি আসাদুজ্জামান লিটন এসব কিছুর সাথে জড়িত থাকলেও চাকরি হারানোসহ নানারকম হুমকি-ধমকির কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চাননা। যদিও তিনি মাদ্রাসার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন অবৈধভাবে এবং কোনো নির্বাচন ছাড়াই। তাদের দুর্নীতির তালিকায় আরও রয়েছে, টিউশন ফি’র টাকা জাল স্বাক্ষর দিয়ে একাউন্ট থেকে তোলা, ট্রেনিংয়ের সময় অফিস খরচের নামে ১হাজার টাকা করে চাঁদা আদায়ের মতো ঘটনাও।

দীর্ঘ ৯ বছর যাবত পারিবারিক ধন্ধের জের ধরে মাদ্রাসা থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী গোলাম মাসুদ যাকে বিগত ২০২২সালের জুলাইয়ের ১ তারিখে অর্থের বিনিময় পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। আর ১৯৯০ সনে সেখানকার ইবতেদায়ী শিক্ষক হাবিবের ইস্তফা দেওয়ার পর তার ১২ মাসের বেতন তুলে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে সুপারের বিরুদ্ধে।  এনিয়ে তখন মামলাও হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আসা বরাদ্দের টাকা, সিডর বন্যার সময় আসা ত্রাণ সামগ্রীসহ সকল কিছু বণ্টন না করে ভোগ করার অভিযোগ আছে মাদ্রাসার সুপার ও সভাপতির বিরুদ্ধে। 

এমন নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ফলে শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান এখন যেন একটি পরিণত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিতে ১ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না খোদ মাদ্রাসা সুপারও। তার দাবি, প্রতিষ্ঠানটিতে মোট দশটি শ্রেণি মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০ জনের মতো। যদিও সেখানে বর্তামানে শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ৪০-৪৫ জন। আর বর্তমানে শ্রেণি প্রতি উপস্থিত পাওয়া যায় ১ থেকে সর্বোচ্চ ৩ জন। এখানেও রয়েছে নানা জালিয়াতি; প্রতিষ্ঠানটিতে এর আগের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরিদর্শনের সময় শিক্ষার্থী আনা হয়েছে পাশের রওজাতুল জান্নাত নামের একটি বেসরকারি মাদ্রাসা থেকে।

মাদ্রাসায় অনুপস্থিত থেকে মাদ্রাসা সুপারের মাধ্যমে হাজিরা দিয়ে টানা ১২ বছর ধরে বেতন তোলা মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষিকা নাহিদা আক্তার শিক্ষার্থীরা তাকে না চেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে না এবং সেজন্য তারা তাকে চিনতে পারছে না। তিনি নিয়মিত ক্লাস করেন জানিয়ে বলেন, আমি এখন ছুটিতে রয়েছি। আর এ বিষয়ে আপনি মাদ্রাসার সুপারের সাথে কথা বলেন। তাঁকে একই রকম এবং কয়েকদিন পর পর স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন এবং এরপর তার সাথে ভিন্ন ভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি।

দূর্গাপুর হাজী মোবারক আলী দাখিল মাদ্রাসার সুপার মোঃ দেলোয়ার হোসেন এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপূর্বক দেয়া হয়েছে এবং অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। ক্লাস রুটিনে নাহিদা আক্তারের নাম না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আপনাকে এ বিষয়ে আগামী পরশু রুটিন দেখাতে পারবো। মাদ্রাসার সভাপতি আসাদুজ্জামান লিটনের দীর্ঘ ১২ বছর একই পদে কোনো নির্বাচন ছাড়াই থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সভাপতির পক্ষে সাফাই জানিয়ে বলেন, নির্বাচনে তদার বিপরীতে কোনো প্রার্থী না থাকায় তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।

নানারকম নিয়োগ থেকে আর্থিক অনিয়ম, সিল জালিয়াতি করে টাকা উঠানো, প্রতিষ্ঠানের গাছ বিক্রি বাবদ অর্থসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; এটি তাদের বাড়ির সামনের এবং তাদের প্রতিষ্ঠান এখানে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই; সভাপতি খুব ভালো মানুষ।

দূর্গাপুর হাজী মোবারক আলী দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি আসাদুজ্জামান লিটনের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এরকম কোন কিছুই ঘটেনি। কোনো অনিয়ম এখানে হয়নি বরং আমি আমার পক্ষ থেকে টাকা দিয়ে থাকি; এখানে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি।

আর অবৈধভাবে তিনি কোনো নির্বাচন ছাড়াই সভাপতি থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি আরও দশ বছর আগেই এ পদ ছেড়ে দেওয়ার জন্য চেয়েছি। কিন্তু, তার জন্য যোগ্য কোনো ব্যক্তিকে না পাওয়ায় আমিই এখনো দায়িত্ব পালন করছি। এটি আমার বাবার দেওয়া প্রতিষ্ঠানে; সেজন্য আমরা একে দেখে রাখছি।

আর শিক্ষিকা নাহিদা আক্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে আমাদের তিনজন আত্মীয় রয়েছেন। তার ক্লাস না থাকা বা অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আপনি সুপারের সাথে কথা বলেন; বা যারা অভিযোগ দিয়েছে তাদের থেকে খোঁজ নেন। 

নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার বীথিকা সরকার বলেন, আমরা এ রকম কোনো অভিযোগ পায়নি; আমি কালকেই খোঁজ নিবো। এসব বিষয়ে কোনো অনিয়ম পেলে আমরা ব্যবস্থা নিবো। কোনো শিক্ষক যদি প্রতিষ্ঠানে না আসেন তাহলে তার আর থাকার প্রয়োজন নেই বলেও জানান তিনি।

একটি মাদ্রাসায় এমন নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিস্মিত হন বরিশাল জেলা শিক্ষা অফিসার জাকির হোসেন। তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবো; কোনো অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা থাকলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়মে চলবে এবং এটি কারো মনমতো চলতে পারে না; আমরা ব্যবস্থা নেবো।


সর্বশেষ সংবাদ