বর্তমান ব্যবস্থায় নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই
অধ্যাপক কাজী নিয়ামুল হক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের পরে সংকটময় মুহূর্তে ১৯৫০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। সম্প্রতি দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক পরিবেশ, শিক্ষা কার্যক্রমের অবস্থা ও কলেজটি নিয়ে আগামীর পরিকল্পনার বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওয়ালিদ হোসেন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঢাকা সিটি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণের পর সার্বিক বিষয় নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: ঢাকা সিটি কলেজ দেশের অন্যতম বড় কলেজ। এত বড় একটি কলেজে দায়িত্ব পালন করা কঠিন। গত আগস্টে ছাত্র ও জনতার দাবির মুখে সংকটময় পরিস্থিতিতে আমরা কলেজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ কলেজটা তো চালাতে হবে। গত ১৬ বছরে কলেজকে জঞ্জালে পরিণত করেছে বিগত প্রশাসন। এটা ছিল আওয়ামী বাকশালী চক্রের একটি অফিস। সেখান থেকে আমরা মুক্ত করেছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়নে আপনার পরিকল্পনা কী?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: আমাদের সিটি কলেজে শিক্ষার মান বরাবরই ভালো। ছেলেমেয়েদের ক্লাসে উপস্থিতি ১০০% নিশ্চিতে চেষ্টা করা হয়। গত বছর সিটি কলেজের এইচএসসি ফলাফলের একটু বিপর্যয় হয়েছে। তবে এ বছর ভালো ফলাফল হবে ইনশাল্লাহ। অনার্সের শিক্ষার্থীদের দিকে আমরা বিশেষভাবে খেয়াল রাখি। সিটি কলেজে উন্নতমানের শিক্ষক রয়েছে। অনার্সে আমরা সকল কোর্স কারিকুলাম পরীক্ষার আগে শেষ করি।
অনার্সে আমাদের ভালো শিক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু ইতিপূর্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রমে যে অনিয়ম সেকারণে অনার্সে আমাদের ভর্তির হার অনেক কমে গিয়েছিল। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন ভিসি স্যার আমাদের নবীনবরণে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। সিটি কলেজের অনার্সে আবার নবজীবন লাভ করবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এখানে শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম কী কী এবং এটি বাড়ানো হবে কি-না?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: আমরা সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ৮ টি ক্লাব খুলেছি। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আমাদের কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট প্রতিযোগিতায় এবং মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ছেলেরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। আমাদের স্পোর্টস ক্লাব রয়েছে। সায়েন্স ক্লাব আছে, সায়েন্স ফেস্টে রাজউক কলেজে আমাদের ছেলেরা অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। আমাদের পরিবেশ ক্লাব রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি লেখাপড়ার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম নেতৃত্ব তৈরি করে। প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। আমাদের পত্রিকা বিভাগ আছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সিটি কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষার মান বাড়াতে আপনার পরিকল্পনা কী?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: পরিকল্পনা হল আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীদের স্থান সংকলন হয় না। আমরা সিটি কলেজে সব ক্যাম্পাস চালু করতে চাই। চালু হলে স্থান সংকুলান দূর হবে। শিক্ষা কার্যক্রমে গতি আসবে। গত ৭ আগস্টে দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে আমরা জাপান বাংলাদেশ হাসপাতালের পেছনে জিগাতলায় আমাদের কলেজের সুসজ্জিত একটি বিল্ডিং ছিল, যেটা এতদিন বেদখল হয়ে ছিল। সেটা উদ্ধার করেছি। এখন সেখানে ক্লাস হচ্ছে।
আমরা অনতিবিলম্বে আমাদের অনার্সের বিভাগগুলো যতটুকু সম্ভব সেখানে সিফট করবো। আমরা আশা করি আমাদের পূর্বাচল ক্যাম্পাস আগামী বছর থেকে চালু করতে পারবো। কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থেকে কলেজের চেয়ারম্যান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার সহ সকলের সহযোগিতায় সিটি কলেজের শিক্ষার আগের গতি ফিরে পেয়েছে এবং সিটি কলেজ এই ধারা অব্যাহত রাখবে ইনশাল্লাহ। জুলাই বিপ্লবের পরে সিটি কলেজ আল্লাহর রহমতে ও সকলের প্রচেষ্টায় খুব সুন্দর ভাবে চলছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে—এটি রোধের কোনো উপায় আছে কি-না?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে বর্তমানে আমাদের শিক্ষার্থীদের মারিমারির ঘটনা ঘটেনি। আশা করি আর হবে না। কারণ আমি মনে করি, গোটা বাংলাদেশ এখন এক হয়ে গেছে। এটা নতুন বাংলাদেশ। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের পরে গোটা বাংলাদেশ এক ও ঐক্যবদ্ধ। এ ধরনের গোলমাল আর হবে না। আমাদের পক্ষ থেকে মেসেজ আমাদের কারো মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কোন ব্যবধান নেই। আমরা সবাই এক।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জুলাই বিপ্লব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তী কার্যক্রমে এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সিটি কলেজের কেউ নিহত হয়নি, আহত হয়েছে প্রায় দুইশত শিক্ষার্থী। আমাদের কাছে তালিকা আছে ৫২ জনের, নবীনবরণে তাদের কিছু সংখ্যককে সংবর্ধনা দিয়েছি।
আমরা গতদিন সিটি কলেজের পক্ষ থেকে রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করেছি। ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী সরকার আমাদের নবি ও রাসূল এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তার বিরুদ্ধে আমরা ছাত্র শিক্ষক মিলে সেখানে প্রতিবাদ জানিয়েছি। যেকোনো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদের এই প্রতিবাদ চলবে।
‘‘আবার যদি বাংলায় কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আমরা সবাই আবার রাজপথে নামবো। কারণ আমরা শুধু ক্লাসরুমের শিক্ষক না। আমরা রাজপথে নামতে প্রস্তুত। জুলাই আগস্ট বিপ্লবে আমরা ছেলেদের সাথে ছিলাম। সিটি কলেজের ছেলেরা যখন আহত হয়ে কলেজের গেটে করাঘাত করেছে , নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছে প্রশাসন তখন গেট খুলে নাই।’’
আল্লাহর রহমতে আমানিশার অন্ধকার দূর হয়েছে। ১৬ বছরের স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে। এই থেকে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের মানুষ বিজয় অর্জন করবে যখন হোক যে অবস্থায় হোক। কারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শুধু পড়ালেখা করেনা তারা অন্যায়, অত্যাচারের ও জুলুমের বিরুদ্ধে রাজপথে সবসময় স্বেচ্ছার থাকে এবং থাকবে। এটাই আমাদের চেতনা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে কীভাবে সংস্কার করলে দেশের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: শিক্ষাক্ষেত্রে দুইটি বিষয়কে মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের দক্ষতা উন্নয়ন। বর্তমান পৃথিবীতে দুটো বিষয় শিক্ষার মাপকাঠি একটি হচ্ছে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ এবং কম্পিউটারের উপর দক্ষতা। আইটি বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি ছাড়া ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে ভালো কিছু করা সম্ভব না। পৃথিবী এখন এআই তে চলে গেছে।
আমাদের আইটির বিষয়গুলো দ্রুত ধারণ করতে হবে , চর্চা বাড়াতে হবে। এজন্য সরকারের উচিত হবে দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা। এখন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা দরকার।এটা ছাড়া শুধু নলেজ কাজে লাগবে না।শুধু ডিগ্রি,মাস্টার্স ডিগ্রি বাংলাদেশে এখন খুব বেশি কাজে লাগে না আমার মনে হয়। আমরা যদি এসব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত করতে পারি তাহলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এখানকার শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান উন্নয়নে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান উন্নয়নে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গত ১৬ বছরে স্বৈরাচারী সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। আমরা এই শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা বিজাতীয় সংস্কৃতিকে লালন করে। বাংলাদেশের আপামর সংস্কৃতিকে লালন করে না , ধারণ করে না। সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা জরুরি। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে দেশ, জাতি ও সংস্কৃতি ধারণ করে লালন করে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করবে বলে আশা করি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার বার্তা কি থাকবে?
অধ্যাপক কাজী নিয়মুল হক: শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার মেসেজ হল নতুন এই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে, দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। বিচার, আইনকে নিজের হাতে তুলে নিবো না। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবো। সরকারের ইতিবাচক সকল পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাবো। যদি ভুল পদক্ষেপ নেয় তাহলে আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করবো। সমালোচনার সুযোগ সকলের রয়েছে, এটা গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে।