মতবিনিময় সভায় আলোচকরা
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতি দরকার
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪, ০৬:৫৫ PM , আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৪, ০৬:৫৫ PM
বাংলাদেশে এবারের বাজেটে ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির চাপে হিমশিম খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। যা নিঃসন্দেহে ভালো একটি পদক্ষেপ। তবে প্রকৃত উপকারভোগীর বিশাল একটা অংশ এখনও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় আসতে পারেনি। প্রকৃত উপকারভোগীদের সঠিক তালিকা না থাকা, শিক্ষার অনগ্রসরতা, জবাবদিহির অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, স্বজনপ্রীতি, লিঙ্গ বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অভাব, নিয়মিত মনিটরিং না করা প্রভৃতি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় আসার জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাজধানীর সিক্স সিজনস হোটেলে ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এডভোকেট সানজিদা খানম।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জাকিয়া আফরোজ, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. আনোয়ার হোসেন এবং ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন।
আরও পড়ুন: দেশে ন্যায্য কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহবান ওয়েভ ফাউন্ডেশনের
মতবিনিময় সভায় সামাজিক নিরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করেন গবেষক আহমেদ বোরহান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ও সঞ্চালনা করেন, ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা। এছাড়াও এতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, নাগরিক সমাজ, যুব ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে মহসিন আলী বলেন—মূলধারার আমরাই দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হিজড়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে আসলে পিছিয়ে রাখি। কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রও পিছিয়ে রাখে। যেমন, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য প্রয়োজনীয় আইন দরকার। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন বলে আশা করি। সামাজিক সুরক্ষাসহ সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য দরকার সুশাসন নিশ্চিত করা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সরকারকেই প্রথমে তৎপর হতে হবে, নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। এজন্য সরকারের তত্ত্বাবধানে একটি সমন্বিত কাঠামো বা ব্যবস্থা তৈরি ও কার্যকর করা প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়নের যে মূলমন্ত্র ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়’ বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সরকারও এ লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য সানজিদা খানম বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার খাদ্য ও অর্থ সহায়তা, প্রশিক্ষণ, ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে এমডিজি বাস্তবায়নের জন্য পুরস্কার পেয়েছে। সে ধারাতেই সকল ধরনের মানুষের উন্নয়ন ও সকলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার এগিয়ে যেতে চায়। দরকার সকল অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়। তাহলেই আমরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাব।
আরও পড়ুন: ‘শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে সামাজিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, সামাজিক নিরীক্ষার এ ফলাফল পরিসংখ্যান ব্যুরোর অনুমোদন নিয়ে প্রকাশিত হলে গবেষকরা পরবর্তীতে তা ব্যবহার করতে পারবেন। সামাজিক খাতে এবারের যে বাজেট বরাদ্দ তা জিডিপির প্রায় আড়াই শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের জন্য বরাদ্দও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯টি কর্মসূচির জন্য প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি ও বেসরকারি খাত সমন্বয়ের মাধ্যমে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
সিলেট এবং ঢাকায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য পাইলট ভিত্তিতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। তাদের ভাতা গ্রহণের ক্ষেত্রে ৫০ বছর বয়সের যে একটি সীমা রয়েছে, সেটি তুলে দেয়া হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে যেসব সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রাণীসম্পদসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ফলাফলে প্রভাব ফেলছে। এভাবেই সমন্বয়ের মাধ্যমে সরকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও অভিযোজনকেও বিবেচনায় নিতে হবে।
জাকিয়া আফরোজ বলেন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ভিজিডিসহ অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে, যা আরও উন্নত করার প্রক্রিয়া চলছে। গর্ভবতী মায়েদের ভাতা সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়।
আরও পড়ুন: ভাগ অংশের সমাধান পারে না প্রাথমিকের ৯৫% শিশু
মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, মাঠ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে মনে হলো, ওয়েভ ফাউন্ডেশন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে যে কাজ করেছে তার ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের দিকেও আমরা এগিয়ে যাব, যার জন্য সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে এবারের বাজেটে গত অর্থবছরের চেয়েও দশ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, বিবেচনায় রাখা হয়েছে বর্তমান বিশ্ব ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়টিও। কর্মমুখী ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে যুক্ত করলে তাদের ক্ষমতায়ন টেকসই হবে।
প্রকল্প শেষ হলেও এডভোকেসি নেটওয়ার্ক কমিটি সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে এ কাজের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে- এ আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, দাতা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা এ প্রকল্পের কাজগুলোকে অন্যান্য জেলাতেও সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
নুজহাত জাবিন বলেন, আমরা যাদেরকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলি, তারা আসলে আমাদেরই কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য পিছিয়ে রয়েছেন। আমাদের মতো তাদেরও রয়েছে সম-অধিকার, সেটা যদি সকলে বিবেচনায় নিই তাহলেই আরও অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। সবাই যেভাবে কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, প্রকল্প শেষ হলেও এ কাজের ধারাকে অব্যাহত রাখবেন আশা করি।
আরও পড়ুন: কর ন্যায্যতা নিয়ে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ’ (ইএলএমসি) শিরোনামে প্রায় ৪ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প দলিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, হিজড়া এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন, অংশীজনদের স্থানীয় সংগঠন ও নেটওয়ার্কগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের সুশাসন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে রাজশাহী, সিলেট, খুলনা বিভাগের আটটি জেলার ৭৩টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে উপকারভোগীদের তালিকায় স্বচ্ছতা এবং ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা; বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে এডভোকেসি নেটওয়ার্ক কমিটির তৎপরতা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।