নেই ছুটি, বিদেশের মাটিতে যেমন কাটছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ঈদ
প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ইউনেস্কো প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী বিদেশের মাটিতেই কাটাচ্ছেন মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। রমজান মাসব্যাপী রোজা রেখে এবারেও ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজন ছাড়ে।
তবে অনেকেই বিদেশের মাটিতেই গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন বন্ধু কিংবা কারও আবার রয়েছে আপন বা দূর সম্পর্কের আত্নীয় স্বজন। কিন্তু নিজের পরিবারের অপূর্ণতা যেন কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। ইউরোপ, আমেরিকাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ঈদ ভাবনা তুলে ধরেছেন তৌফিকুল ইসলাম আশিক।
কোরিয়ার কিয়ংডং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মার্ট কম্পিউটিং বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী এনামুল হোক রোমিও। ঈদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, ‘বলতে কষ্ট হলেও এটাই সত্যি যে, ঈদের দিনেও দুপুর ১টা পর্যন্ত ভার্সিটিতে ক্লাস চলবে। ক্লাস শেষ করে সরাসরি একদম কাজে যেতে হবে। কর্মস্থলে বলার পরও ছুটি পেলাম না। ৭ ঘণ্টা কাজ করে রাত ১০টায় বাসায় ফেরা, এই হলো ঈদের দিনের প্ল্যান। এর মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠেই ঈদের নামাজ আদায় করবো।’
পরিবারকে ছেড়ে এনামুলের এটি তৃতীয় ঈদ। পরিবারের বাইরে ঈদ নিয়ে বলেন, ‘পরিবারের জন্যই এসেছি কষ্ট হলেও মানিয়ে নিতে হবে। এই কষ্ট হয়ত সবাই বুঝবে না।’
পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ মিস করার পাশাপাশি একমাত্র ভাইয়ের বিয়েও মিস করবেন এনামুল। পরিবারের জন্য এনামুলের বার্তা, ‘আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, যে কারণে আপনাদেরকে ছেড়ে এই ভিনদেশে পড়তে এসেছি সেটা যেন আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। ইনশাআল্লাহ আপনাদের ছেলে সফল হয়ে আপনাদের কাছেই ফিরবে।’
সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে অধ্যয়নরত নাজনীন আক্তারও অনেকটা একই কথা বলেন। তিনি জানান, ‘যেহেতু পার্ট টাইম কাজ করা হয় তাই সেভাবে কোনো প্ল্যান নেই। কাজে ছুটি দিবে কি দিবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ছুটি পেলে বাহিরে একটু ঘুরাঘুরি করবো।’
পরিবারকে ছাড়া নাজনীনের এটি দ্বিতীয় ঈদ উল ফিতর। নাজনীন বলেন, ‘পুরো রমজান মাসই খুবই আবেগে থাকি। এই মনে হয় যে, সব ফেলে রেখে দেশে চলে যাই। ভাবতেই কেমন জানি লাগে। কিন্ত আবার সেই বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। সত্যি বলতে ঈদ বলে যে স্পেশাল ডে হিসেবে কোথাও শপিং এ যাব সেই সময়টুকুই মেলেনা এখানে। এতটাই রোবোটিক লাইফ। কিন্তু হ্যাঁ ইচ্ছা আছে চাঁদ রাতে কিছু কেনা হবে। যতই হোক নতুন জামা ছাড়া ঈদ হয় না।’
পরিবার ছাড়া ঈদ কাটানো নিয়ে নাজনীন বলেন, ‘বরাবরের মতই পরিবার আর দেশকেই বারবার মিস করব। পরিবারের জন্য জমানো কথা বলতে গেলে শেষ হবে না।’ গতবছরের ইদের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে গতবছরের ঈদ আমার জন্য প্রথম ছিল এবং অনেকটা সারপ্রাইজিং ছিল। সবাইকে নামাজ শেষে এসেই কাজে চলে যেতে হয়েছিল। ঈদ বলতে কিছুই নেই এই দেশে। এখানে ঈদে কমিউনিটির পক্ষ থেকে বিশাল পরিসরে ঈদ আয়োজন করা হয়। দেখলে মনে হবে এই যেন বাংলাদেশ। তবে সেখানে আমাদের মত স্টুডেন্টদের জয়েন করে সময় কাটানো হয়ে উঠেনা।’
এবারে ইদের দিনে ক্লাস আছে নাজনীনের। তবে গত দুই মাস আগে সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক সিদ্ধান্ত জানায় যে, এবার থেকে ঈদ ডে কে হলিডে হিসেবে একাডেমিক ক্যালেন্ডারে যোগ করা হবে। এটিই যেন নাজনীনের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়।
পরিবারকে ছাড়া প্রথম ঈদ কাটাবেন ফিনল্যান্ডের সেন্ট্রিয়া ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাপ্লাইড সায়েন্স এর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের শিক্ষার্থী ইরফান চৌধুরী অর্নব। ইদের দিনে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে ফিনল্যান্ডে থাকা একাধিক আত্মীয়-স্বজন এবং বাঙালি কমিউনিটির সাথে নামাজে যাওয়া তার প্রথম প্ল্যান। অর্নব সবচেয়ে বেশি মিস করবেন ঈদে সবাই মিলে একসাথে নামাজে যাওয়া, নামাজ থেকে এসে সালামি নেয়া আর বিকেলে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া। এসবই বলছিলেন তিনি।
পরিবারের উদ্দেশ্যে অর্নব বলেন, ‘আমাকে তোমরা মিস কোরো না। শীঘ্রই দেশে আসবো, সবার সঙ্গে দেখা হবে।’ দেশে কাটানো গত বছরের ঈদের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন,‘গত ঈদে সবাই আলোচনা করেছিল এবার আমি দেশে থাকবো না। সবার মন খারাপ ছিল।’ ফিনল্যান্ডের বাঙালি কমিউনিটি ঈদে বেশিরভাগই কাজ থেকে ছুটি নেয়। সবাই সবার বাসায় ঘুরতে যায়। ঈদের দিনে অনেকের ক্লাস থাকলেও শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে লিভ নেয়া যায়।’
ত্যাগের মাস রমজান শেষে এনামুল, নাজনীন এবং অর্নবদের মতো লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী প্রতিবছর এভাবেই পরিবারের সঙ্গে আনন্দ উদযাপন ত্যাগ করে পড়াশোনা করছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। ঈদ বয়ে নিয়ে আসুক সকলের জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি।