বেকারত্বের অভিশাপ কাটিয়ে এখন সফল উদ্যোক্তা মামুনুর
ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগরে বেড়ে ওঠা মো: মামুনুর রশিদ সিদ্দীকীর। কাজ করছেন লিড জেনারেশন বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে। সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পেয়েছেন ‘ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সার কনফারেন্স ২০২৩’-এ সম্মাননা। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: আমি মো: মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী। আমার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট। ২০১০-১১ সেশনে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে কম্পিউটার টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা করি। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় জবের উদ্দেশ্য ঢাকায় আসি। পরবর্তীতে জবের পাশাপাশি একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে বিএসসি কমপ্লিট করি।
ফ্রিল্যান্সিং কাজে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে গত ১৯ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে চট্টগ্রাম বিভাগের সেরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সম্মাননাও পাই। কমিউনিটিতে কন্ট্রিবিউট করতে ফ্রিল্যান্সিং এর পাশাপাশি যৌথভাবে ‘এমআইটি সল্যুশনস’-নামে ফ্রিল্যান্সড ভিত্তিক একটি আইটি প্রতিষ্ঠান চালু করি, যা মহাখালী, ঢাকায় অবস্থিত। যার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং টেকনিক্যাল পার্টনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি|
আলহামদুলিল্লাহ, যেখানে ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। উল্লেখ্য, এজেন্সি হিসেবে আমরা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়েও কাজ করে থাকি।
এছাড়াও, এককভাবে ‘মামুন কনসালটেন্সি’ নামে আমার কনসালটেন্সি এজেন্সি সীমিত পরিসরে যাত্রা শুরু করেছে। এটা মূলত ভার্চুয়াল এজেন্সি। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে, ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বাড়ানো এবং সফল উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করা। আইটি খাত খুবই সম্ভাবনাময় খাত। আমি প্রপার সহযোগিতা পেলে কিভাবে একজন ফ্রিল্যান্সার থেকে উদ্যোক্তা হওয়া যায় সেই মডেলটা নিয়ে কাজ করব, ইনশাল্লাহ।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ফ্রিল্যান্সিং-এর শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: হতাশায় শুরু আমার ক্যারিয়ার। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমার পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি অনলাইনে আয় করার জন্য ‘ক্লিক টু আর্ন’ ভিত্তিক বিভিন্ন কাজ শুরু করি। কিন্তু ভুয়া এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ৯ হাজার টাকা লোকসান হয় আমার। পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই এতগুলো টাকা লোকসান হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ি, পরে বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় একটি ট্রেনিং সেন্টারে মাইক্রোসফট অফিস, এক্সেল বা অফিসিয়াল কাজ শিখার জন্য জন্য ভর্তি হই ।
কিছুদিন পর একটি মাল্টিমিডিয়ার রেকর্ডেড কোর্স কিনে আমি আরও নতুন কিছু কাজ শেখা শুরু করি এবং ওডেস্কে (বর্তমানে আপওয়ার্ক)-এ প্রোফাইল প্রস্তুত করি।
শুরুতে দীর্ঘদিন কাজ না পাওয়ার কারণে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হয় আমার। সে সময় পরিবারের আর্থিক সমস্যা দূর করতে এলাকায় কম্পিউটার মেরামত ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করি। তবে সফলতা না পাওয়ায় ঢাকায় এসে একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নি হিসেবে কাজ শুরু করি। ইন্টার্নশিপ করার সময় ফ্রিল্যান্সিং কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে এ কাজের জন্য দক্ষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় আট বছর চাকরি করার পর নিজেই পুরোপুরিভাবে ফ্রিল্যান্সিং কাজ শুরু করি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং কেন বেছে নিলেন? ফ্রিল্যান্সিং-এ এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনি মনে করেন?
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: ঢাকায় অবস্থিত যে প্রতিষ্ঠানে জব শুরু করি সেটি ছিল ফ্রিল্যান্সিং ভিত্তিক । সেখানে শুরু থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং এর একটি সেক্টর বিটুবি লিড জেনারেশন নিয়ে কাজ করি| এই কাজের চাহিদা অনেক এবং দিন দিন চাহিদা বেড়েই যাচ্ছে যে কারণে এই সেক্টরটা বেছে নেয়া|
বর্তমান দুনিয়ায় স্মার্ট মার্কেটিং এর জন্য টার্গেটেড অডিয়েন্স খোঁজে সরাসরি মার্কেটিং করা অনেক বেশি ইফেক্টিভ| এজন্য বিটুবি লিড জেনারেশন ফ্রিল্যান্সিং-এ অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি নিজের জন্য ক্লায়েন্ট খুঁজতেও সাহায্য করে| এছাড়া, এটি অন্যান্য স্কিল এর তুলনায় কিছুটা সহজ এবং অনেক জনপ্রিয়ও বটে|
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিজের প্রথম কাজ এবং আয়ের অনুভূতি কী?
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: মার্কেটপ্লেস থেকে প্রথম সফল কাজ ছিল মাত্র ২০ ডলারের এবং আর কাজটিও ছিল বিটুবি লিড জেনারেশন রিলেটেড| কি যে ভালোলাগা তখন কাজ করেছে তা আসলে বলে বুঝানো সম্ভব না| উল্লেখযোগ্য বিষয়, আমার প্রথম কাজ পাওয়া ক্লায়েন্টের সাথে এখনো মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়| বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়|
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরুতে কোন বিষয়গুলো বাধা হিসেবে কাজ করেছে এবং সেগুলো থেকে কীভাবে বের হয়েছেন?
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: ‘চাকরির পাশাপাশি ২০১৪ সালে পুরোদমে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করি। এ সময় আমি মূলত সাবেক প্রতিষ্ঠানের মালিকের সাথে ৫০-৫০ ডিলে প্রকল্পভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতাম। হঠাৎ একটা বড় প্রকল্পের কারণে আমাকে স্থায়ী বা নির্দিষ্ট বেতনে সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরির অফার করেন তিনি। রাজি না হলে অনলাইনে কাজ না দেওয়ার কথাও জানান। তখন বাধ্য হয়েই নির্দিষ্ট বেতনে তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি। একই সময়ে ব্যক্তিগতভাবে ফাইভার এবং আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে থাকি। কিন্তু কিছুদিন পর প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফ্রিল্যান্সিং কাজ করতে বাধা দেওয়া হয় এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেসে থাকা আমার সব প্রোফাইল অকার্যকর করে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ কর্পোরেট পলিটিক্স এ অতিষ্ঠ হয়ে গত ২৩শে মার্চ ২০২২-এ প্রায় আট বছরের ফ্রিল্যান্স বেসড জব ছেড়ে ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ফোকাস করে কাজ শুরু করি। উল্লেখ্য, জব ছাড়ার সময় আমার টপ-রেটেড আপওয়ার্কের প্রোফাইলটাও ডিজেবল করে দেন আমার সাবেক কোম্পানি।
যেহেতু আমার জব ক্যারিয়ারটা ছিল ফ্রিল্যান্সিং ভিত্তিক সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে নিজের নামে এবং পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পূর্ণ নতুন প্রোফাইল খুলে কাজ শুরু করি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ফ্রিল্যান্সিংয়ে ব্যর্থতার কী কী কারণ হতে পারে?
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: যেকোনো কাজে সফলতা এবং ব্যর্থতা দুটোই থাকবে। তবে সমস্যাটা শুরু হয় তখন যখন একি রকম কিছু কারণে বারবার প্রতিশ্রুতিশীল ফ্রিল্যান্সাররা ব্যর্থ হয়ে এই প্রতিযোগিতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে, যা খুবই দুঃখ জনক। আমার দৃষ্টিতে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ব্যর্থতার কয়েকটি কারণ নিচে উল্লেখ করে দিলাম |
=) পর্যাপ্ত এবং সঠিক দক্ষতার অভাব:-
অনেক তরুণ উদ্যোক্তা/ ফ্রিল্যান্সার ক্যারিয়ার শুরুই করে লোভ বা ভুল তথ্য পেয়ে। অনেকেই মনে করেন কম্পিউটার বা এন্ড্রয়েড মোবাইল থাকলে এবং ফাইভার / আপওয়ার্ক এ একাউন্ট থাকলেই হাজার হাজার ডলার ইনকাম করা যায়। অনেকে যাচাই বাচাই না করে ভুয়া ট্রেনিং সেন্টার বা কোর্সে ভর্তি হয়ে পর্যাপ্ত এবং সঠিক দক্ষতার অভাবে ঝরে পড়ে|
=) ইংরেজিতে দুর্বলতা:
আমাদের দেশে ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সার এই সেক্টরে সফল হতে পারছেন না| কেউ যদি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফল হতে চায় তাকে অবশ্যই ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা থাকা আবশ্যক|
=) সঠিক পরিকল্পনার অভাব:-
যেকোনো কাজে সফল হতে সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হয়| এই সেক্টরে এক স্কিল এবং এক ক্লাইন্ট এর কাজ সারা বছর থাকে না। তাই বছরের কোন সময় কি নিয়ে কাজ করবেন কোন ক্লাইন্ট এর কখন কোন ধরনের কাজ প্রয়োজন হতে পারে তার বিস্তারিত ধারনা থাকতে হবে। যদি সঠিক পরিকল্পনার অভাব হয় তাহলে সফল হতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে|
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুনদের জন্য সঠিক গাইডলাইনটি কী হতে পারে?
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: ফ্রিল্যান্সিং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পেশা। ঘরে বসে অল্প সময়ে অধিক আয় করা যায় এবং আছে কাজের স্বাধীনতাও। তবে সমস্যা হলো অন্য জায়গায় যারা নতুন ফ্রিল্যান্সিং শিখতে চাচ্ছেন। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে উৎসাহিত হয়ে টাকা ইনকামের লোভে নিজের দক্ষতার দিকে লক্ষ্য না করে মার্কেটপ্লেস গুলোতে কাজ করতে আসে।
তাদের প্রথম টার্গেট টাকা কামানো হওয়ায় কাজের প্রতি ততটা গুরুত্ব দেয় না। ফলে বায়ারের রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় একটা বাজে রিভিউ পায়, যা তাদের গিগের র্যাংক ডাউন করে দেয়| শুরুতেই হচ্ছেন আশাহত|
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নতুনদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে; ভালো প্রতিষ্ঠান বা মেন্টরের কাছে কাজ শিখুন| তারপর কমপক্ষে ৩-৬ মাস কোন টিম বা এজেন্সিতে কাজ করে নিজেকে প্রস্তুত করে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে মার্কেটপ্লেসে আসা উচিৎ|
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন ফ্রিল্যান্সার এর পোর্টফোলিও বিল্ড আপ করার ব্যাপারে কিছু বলুন।
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: পোর্টফোলিও হলো একটি ব্যক্তিগত কাজের সংক্ষেপ বা প্রদর্শন, যা তার দক্ষতা ও আগের কাজের স্যাম্পলগুলি আবারও দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন কাজ অনুযায়ী পোর্টফোলিও বিভিন্ন ধরণের হতে পারে| উদাহরনঃ ওয়েবসাইট হতে পারে নিজের কিংবা অন্য সাইট যেমন গ্রাফিক্স এর কাজ করলে বিহেন্স, ড্রিবল, ওয়েবসাইট হলে ওয়ার্ডপ্রেস ডট কম কিংবা ব্লগার ডট কম, আর্টিকেল রাইটার হলে মিডিয়াম ডট কম ইত্যাদি সাইট ব্যবহার করে পোর্টফোলিও তৈরি করা যায়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনাকে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে?
মামুনুর রশিদ সিদ্দীকী: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ফ্রিল্যান্সিং করার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। আমার দৃষ্টিতে ইলেক্ট্রিসিটি এবং ইন্টারনেটের পর্যাপ্ত সুবিধা নাই। কেননা এখনো আমি গ্রামে গেলে ইলেক্ট্রিসিটির সমস্যা বা লোডশেডিং এ ভুগতে হয়। এছাড়াও, বিভিন্ন টুলস কেনার জন্য যেসব ডুয়েল কারেন্সি কার্ড ব্যবহার করি এগুলোর লিমিট খুব কম| যেগুলো অনলাইনে ব্যবহার করে কেনা কাটায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়|