চাপাকান্নায় দিন কাটছে মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের

মেস ভাড়া দিতে না পারায় শিক্ষার্থীদের মালামাল ফেলে দিয়েছে মালিক (বামে)। অনলাইনে মেস ভাড়া মওকুফের দাাবি শিক্ষার্থীদের
মেস ভাড়া দিতে না পারায় শিক্ষার্থীদের মালামাল ফেলে দিয়েছে মালিক (বামে)। অনলাইনে মেস ভাড়া মওকুফের দাাবি শিক্ষার্থীদের  © টিডিসি ফটো

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণীতে পড়ুয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মিজানুর রহমান। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন আর খন্ডকালীন চাকরি করে নিজের থাকা খাওয়া কোনরকমে চালিয়ে নেন। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক বাবার সামান্য পেনশনের টাকা আর নিজের পরিশ্রমেই জোগাড় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি।

কিন্তু গত কয়েকমাসের করোনা পরিস্থিতি এবং লকডাউন সম্পূর্ণ হিসাব পাল্টে দিয়েছে মিজানুরের। নির্মম বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাড়িতে থেকেও মাসের পর মাস মিজানুরের পরিশোধ করতে হচ্ছে সম্পূর্ণ মেস ভাড়া। প্রথম দুই মাস মেসভাড়ার টাকা জোগাড়ে খুব সমস্যা না হলেও পরবর্তী তিনমাস ধরে মেসভাড়া পরিশোধ করতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে মিজানুরকে। মিজানুরের কপালে চিন্তার ভাঁজ! চতুর্মুখী চিন্তা, একগাদা হতাশা আর অনিশ্চিত নির্মম ভবিষ্যতের হাতছানি জানান দিচ্ছে আগামীর পথচলা কতটা বন্ধুর হবে।

আজিমপুরে একটি মেসে থেকে ঢাকা কলেজে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করেন কৃষক পরিবারের সন্তান জাকির হোসেন। পরিবারের সামান্য অর্থ সহায়তা আর টিউশন থেকেই মিলতো মেস ভাড়া আর খাবারের টাকা। কিন্তু করোনার ভয়াল থাবায় সবকিছুই ভেস্তে গেছে। করোনার কারণে মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত বাড়িতে অবস্থান করলেও প্রতি মাসেই বিকাশের মাধ্যমে সম্পূর্ণ মেস ভাড়া পাঠাতে হচ্ছে মেস মালিকের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে চরমভাবে হতাশ এই শিক্ষার্থী।

বর্তমান এই করোনা পরিস্থিতিতে এরকম হাজারো মিজানুর আর জাকিরের চাপাকান্না আর নীরব আহাজারি নিভৃতে চাপা পড়ছে চোখের জলে।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চ মাস থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এই সময় ধরে শিক্ষার্থীদের কোলাহল আর হৈচৈ মুখর ক্যাম্পাসে শুধুই শূন্যতা বিরাজ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের থাকার মেস এবং হোস্টেল গুলোও। যার ফলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশের মেস ও হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরা চলে গেছেন নিজের গ্রামের বাড়িতে।

তবে মেস বা হোস্টেল বন্ধ থাকলেও ঠিকই সম্পূর্ণ ভাড়ার টাকা গুনতে হচ্ছে মেসে থাকা এসব শিক্ষার্থীদের৷ শহরের বাসা কিংবা মেসে অবস্থান না করলেও ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালাদের চাপে অনেকটাই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হচ্ছে টিউশনি কিংবা খন্ডকালীন চাকরি করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের দাবি, মেস মালিকরা যেন তাদের ভাড়া মওকুফ অথবা শিথিল করেন।

রাজধানীর আজিমপুর, নিউমার্কেট, চাঁনখারপুল, ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, কলাবাগান, গ্রিণরোড, শাহবাগ, ফার্মগেইট সহ আশেপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন মেস এবং হোস্টেল গুলোতে কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর বসবাস।

বেশ ক’জন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হলে তারা মেস ভাড়া মওকুফের দাবি জানান। তাদের বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজেগুলোতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও কৃষক পরিবারের সন্তান। আর মেসে অবস্থান করা এসব পরিবারের অধিকাংশ সন্তানই টিউশন অথবা খন্ডকালীন চাকরি করে নিজেদের খরচ নিজেরাই জোগাড় করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ থাকায় মধ্যবিত্ত ও কৃষক পরিবারের মানুষেরা অনেকটা কষ্টে জীবনযাপন করছে। এমন অবস্থায় মানবিক দিক বিবেচনা করে এই সংকটময় সময়ে শিক্ষার্থীদের মেস ভাড়া মওকুফ অথবা অর্ধেক কমানো হলে এতেও অনেক শিক্ষার্থী উপকৃত হবে বলে জানান তারা।

মেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পল্লব রায়হান বলেন, আমি আজিমপুরে দুটো টিউশনের টাকায় আমার মেস ভাড়া এবং খাবার চালিয়ে নিতাম। বাড়ি থেকে বাবা তেমন একটা টাকা দিতে পারেন না। কিন্তু এখন সবকিছু বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েছি। একদিকে মেস থেকে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে অপরদিকে পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এমন অবস্থায় মেস মালিকরা যদি আমাদের অবস্থার কথা মানবিকতার সাথে বিবেচনা করেন তবে আমাদের জন্য উপকার হয়।

ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সিরাজুম মুনিরা বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাসহ সকল ধরনের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা টিউশন বা পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটখাটো বিভিন্ন কাজ করে নিজের খরচ বহন করেন। কিন্ত পরিস্থিতির জন্য এখন সেই পথ বন্ধ। এমন অবস্থায় মানবিক বিবেচনায় মেস মালিকদের উচিত ভাড়া মওকুফ করা অথবা কিছুটা হলেও শিথিল করা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব রাফি বলেন, করোনার কারণে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরা প্রায়শই কর্মহীন। আবার এমন অবরুদ্ধ অবস্থায় টিউশন করিয়ে মেসের ভাড়া ও পড়াশোনা বাবদ খরচ বহন করা শিক্ষার্থীদেরও আয়ের উৎস বন্ধ। সেজন্য আমরা চাই মেস মালিকরা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন যাতে উভয়পক্ষের জন্য সুবিধা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে মেস মালিকদের সহনশীল আচরণ করা উচিৎ বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সদ্য সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। তিনি বলেন, বর্তমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে রাজধানীর মেস বা হোস্টেলগুলোর ভাড়া মওকুফ করলে দরিদ্র-অসহায় শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হবেন। আর এক্ষেত্রে মেস মালিকদের কথা মাথায় রেখে পুরো ভাড়া মওকুফ করা সম্ভব না হলেও অর্ধেক ভাড়া কমানো উচিত। এতে মেস মালিক ও মেসের বর্ডার উভয় পক্ষই উপকৃত হবেন।

সমাজের বিশিষ্টজনরাও মনে করছেন, করোনা পরিস্থিতিতে মেসে বা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের পাশে মেস মালিকদের সহায়তার হাত বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করছেন তাঁরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-র সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, করোনার কারণে মেসে বা হোস্টেলে থাকা অনেক শিক্ষার্থীরাই সমস্যায় পড়েছে। এক্ষেত্রে সকল মেস মালিকদের উচিৎ মানবিক বিবেচনায় ভাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করা।

সংকটময় মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের মেস ভাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, বর্তমান সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের সবারই উচিত সবার পাশে দাঁড়ানো। আর শিক্ষার্থীরা অনেকেই যেহেতু টিউশন এবং খন্ডকালীন চাকরি করে নিজের পড়াশোনা ব্যয় নির্বাহ করতো সেক্ষেত্রে এমন অবস্থায় মেস এবং বাড়ির মালিকদের উচিত হবে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence