জন্ডিস নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করা জরুরি 

অধ্যাপক ড. মো. আজিজুর রহমান
অধ্যাপক ড. মো. আজিজুর রহমান  © টিডিসি ফটো

সম্প্রতি রাজশাহীতে জন্ডিসের প্রকোপ বেড়েছে। গত কয়েকদিনে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্ডিস ধরা পড়েছে। গণিত বিভাগের এক শিক্ষার্থী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জন্ডিসের কারণে মৃত্যুবরণ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে জন্ডিস নিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও জন্ডিসের প্রকোপ বিস্তার নিয়ে চিন্তিত। নেয়া হয়েছে নানা ধরনের পদক্ষেপ। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং অ্যাকাডেমিক ভবনসমূহে নিরাপদ পানির সুব্যবস্থা করা, ক্যাম্পাসের দোকানসমূহে নিরাপদ খাবার ও পানি সরবরাহ হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা, জন্ডিস প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানো ও সংক্রমণের উৎস নির্ণয় করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি। রাবি মেডিকেল সেন্টার থেকে পাওয়া তথ্যমতে জন্ডিসে আক্রান্ত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের মেসে অবস্থান করছে। আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য জন্ডিস সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি দূর করা এবং এর নিয়ন্ত্রণে কি কি পদক্ষেপ নেয়া সবচেয়ে জরুরি তা আলোচনা করা। 

ভুল ধারণা-১: জন্ডিস এবং হেপাটাইটিস-এ এক জিনিস 

অনেকের ধারণা জন্ডিস এবং হেপাটাইটিস-এ একই জিনিস। এটি ভুল ধারণা। জন্ডিস কোন রোগ নয়। এটি বিভিন্ন রোগের লক্ষণ। মানবদেহে মোট বিলিরুবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ ০.১-১.২ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার। দেহে মোট বিলিরুবিনের মাত্রা ৩ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের বেশী হলে জন্ডিস দেখা দেয়। কমপক্ষে ৩০টি রোগের লক্ষণ হিসেবে শরীরে জন্ডিস দেখা যেতে পারে। তার মধ্যে একটি হলো হেপাটাইটিস-এ। সুতরাং, জন্ডিস মানেই হেপাটাইটিস এ নয়। হেপাটাইটিস-এ ছাড়াও আরও চার ধরনের ভাইরাল হেপাটাইটিস আছে। যেমন- হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-ডি এবং হেপাটাইটিস-ই। উক্ত সবগুলো ভাইরাল হেপাটাইটিসে জন্ডিস দেখা দেয়। তবে, আমাদের দেশে জন্ডিসের মূল কারণ হেপাটাইটিস-এ এবং  হেপাটাইটিস-ই। তাই, টেস্টের মাধ্যমে রক্তে কোন ভাইরাসের IgM অ্যান্টিবডি  উপস্থিত তা প্রমাণ ছাড়া শুধু বিলিরুবিন টেস্ট করে বলা যাবেনা হেপাটাইটিস-এ-এর কারণেই জন্ডিস হয়েছে।আরটি পিসিআরের মাধ্যমেও হেপাটাইটিসের ধরণ নির্ণয় করা যায়।

ভাইরাল হেপাটাইটিস ছাড়াও আরও অনেক রোগের কারণে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে- লিভার সিরোসিস, হিমোলাইটিক অ্যানেমিয়া, জেনেটিক রোগ (যেমন উইলসন ডিজিজ), পিত্তনালির পাথর, পিত্তথলির ক্যান্সার, অটোইমিউন লিভার ডিজিজ ইত্যাদি। 

ভুল ধারণা-২: হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই শুধু পানির মাধ্যমে ছড়ায়। 

হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই শুধু পানির মাধ্যমে ছড়ায় এ ধারণাটি ঠিক নয়। পাঁচ প্রকারের ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে শুধু হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই মল-মৌখিক পথের (fecal-oral route) মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির দূষিত মল যখন কোন ভাবে অন্য একজন সুস্থ মানুষের মুখের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে তখন সে সুস্থ ব্যক্তি হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রশ্ন হলো, দূষিত মল কীভাবে মানুষের মুখে প্রবেশ করতে পারে? 

এটি বিভিন্নভাবে হয়। যেমন ধরুন, যদি একজন হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই রোগে আক্রান্ত রোগী টয়লেট ব্যবহারের পর তার হাত সঠিকভাবে সাবান, ছাই বা মাটি দিয়ে ভালো করে না ধুয়ে কোন খাবার তৈরি করেন, তখন তার হাতে লেগে থাকা মলে থাকা হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস উক্ত খাবারের মাধ্যমে অন্য মানুষে ছড়িয়ে পড়বে। এভাবে মল লেগে থাকা অপরিষ্কার হাত দিয়ে বিভিন্নভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস সুস্থ মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির মলে থাকা ভাইরাস কোনোভাবে মিউনিসিপ্যালের সরবরাহকৃত পানিতে ছড়িয়ে পড়লে এটি এক সঙ্গে অনেক মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। কোন পানি তখনি হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই-এর কারণ হবে যখন সে পানি কোন ভাবে হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস আক্রান্ত মল দিয়ে দূষিত হবে।

ভুল ধারণা-৩: শুধু নিরাপদ পানি খেলেই জন্ডিসের মূল কারণ হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই রোগ থেকে নিরাপদ থাকা যাবে 

শুধু নিরাপদ পানি আপনাকে জন্ডিস তৈরিকারী হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই থেকে দূরে রাখবে না। হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই থেকে দূরে থাকতে হলে সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হল টয়লেট ব্যবহারের পর ভালো করে হাত ধোয়া এবং অবশ্যই কোন খাবার গ্রহণের পূর্বে উত্তমরূপে হাত ধোয়া। অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে- মিউনিসিপ্যালের সরবরাহকৃত পানি  যাতে হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই আক্রান্ত ব্যক্তির মল দিয়ে দূষিত না হয় সে জন্য পুরাতন পানির পাইপ সংস্কার করা, টিউবওয়েল থেকে টয়লেটের দূরত্ব কমপক্ষে ১৫ ফিট নিশ্চিত করা, একই গ্লাসে একাধিক মানুষ পানি খেলে প্রত্যেক ব্যবহারের পর গ্লাস খুব ভালো করে পরিষ্কার করা, ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদি। 

সারকথা হল, আমাদের দেশে জন্ডিসের অন্যতম কারণ যে দুটি রোগ (হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই) প্রতিরোধ করতে হলে উক্ত রোগ দুটির ভাইরাস যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির মল বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষের মুখের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু টয়লেট ব্যবহারের পর এবং খাবার বা তৈরি বা পরিবেশনের আগে ভালোভাবে হাত ধোয়া নিশ্চিত করলেই জন্ডিসের প্রধান কারণসমূহসহ অন্যান্য অনেক ভয়াবহ রোগের  বিস্তার ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।   

লেখক: অধ্যাপক ড. মো. আজিজুর রহমান, ফার্মেসি বিভাগ এবং পরিচালক, অফিস অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 


সর্বশেষ সংবাদ