মন্ত্রণালয়ের ‘ভুলে’ কপাল পুড়েছে ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্ধশতাধিক শিক্ষকের
- শিহাব উদ্দিন
- প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৩ PM , আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১৬ PM
বগুড়া সদর উপজেলার ফয়জুল্বা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক তাফহিমা জোয়ারদার। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রভাতি শাখায় যোগদান করলেও শিফট বিড়ম্বনায় এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এমপিওভুক্তির জিওতে ডাবল শিফট উল্লেখ না থাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রভাতি শাখার শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না তিনি।
শুধু তাফহিমাই নন; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভুলে দেশের বিভিন্ন জেলার ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্ধশতাধিক শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। দীর্ঘদিন ধরে বেতন ছাড়াই এসব শিক্ষক পাঠদান দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা আমলারা তা আমলে নেননি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
তাফহিমা জোয়ারদার জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি। সুযোগ ছিল অনেক ভালো জায়গায় যাওয়ার। তবে মায়ের অনুপ্রেরণায় মহান এ পেশায় এসেছি। ২০২১ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রভাতী শাখা এমপিওভুক্তির আবেদন করে। অনলাইন আবেদনে স্পষ্টভাবে দ্বিতীয় শিফটের জন্য এমপিওভুক্তির আবেদন করা হয়েছিল। আবদেন যাচাই-বাছাই শেষে এমপিওভুক্তির জিও জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে মাউশি প্রভাতী শাখার জন্য এমপিওভুক্তি উল্লেখ না করায় এমপিওভুক্ত হতে পারিনি।
কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জিও জারি হলেও ডাবল শিফট উল্লেখ না থাকায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। ডাবল শিফটের বিষয়ে কিছু জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও মহিবুল হাসান চৌধুরী কোনো উদ্যোগ নেননি। যার ফলে জটিলতা থেকেই গেছে—রবিউল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) রবিউল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জিও জারি হলেও ডাবল শিফট উল্লেখ না থাকায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। ডাবল শিফটের বিষয়ে কিছু জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও মহিবুল হাসান চৌধুরী কোনো উদ্যোগ নেননি। যার ফলে জটিলতা থেকেই গেছে।
অনলাইনে আবেদনের সময় ডাবল শিফট উল্লেখ করা হলেও জিওতে কেন আসেনি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে কোনো ভুল হয়েছে কি না সেটি দেখতে হবে। যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর যদি কোনো ভুল না থাকে তাহলে এই শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা জারি করতে হবে।
জানা গেছে, বগুড়ার ফয়েজুল্বা উচ্চ বিদ্যালয়; নিশিন্দারা ফকির উদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজ; নাটোরের রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়; পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজ; মেহেরপুরের গাংনী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ এবং গাজীপুরের চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মাধ্যমিক স্তর (প্রথম শিফট) দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এমপিওভুক্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে মাধ্যমিক স্তরে ৬ষ্ঠ হতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ডাবল শিফট (দ্বিতীয় শিফট) চালুর অনুমতি পায়। অনুমতি পাওয়ার পর ডাবল শিফটের প্রতিষ্ঠানগুলো কাম্য সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সরকারি অংশের বেতন-ভাতা ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় শিফটের এমপিওভুক্তির জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করে প্রতিষ্ঠানগুলো।
আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৬ জুলাই এই ৬ প্রতিষ্ঠানসহ মাধ্যমিক স্তরে এক হাজার ১২২টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির গেজেট প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গেজেটের ক্রমিক নং- ৮৪, ৮৫, ২৯২, ৫৯১, ৭০৮, ৮১৯-তে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান শিরোনামে উল্লেখিত ডাবল শিফটের প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারি অংশের এমপিও প্রাপ্তির লক্ষ্যে তালিকাভুক্ত হয়। প্রাপ্ত গেজেটের ভিত্তিতে ডাবল শিফটের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভূক্তির জন্য উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রত্যয়ন সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আঞ্চলিক কার্যালয় বরাবর আবেদন করে। তবে ৬টি প্রতিষ্ঠানের অর্ধশতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন বাতিল করে দেন আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালকরা। আবেদন বাতিলের কারণ হিসেবে বলা হয়, ‘প্রাপ্ত গেজেটে প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটি যে ‘ডাবল শিফট’ তার উল্লেখ নাই।
এক্ষেত্রে কোনো ভুল হয়েছে কি না সেটি দেখতে হবে। যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর যদি কোনো ভুল না থাকে তাহলে এই শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা জারি করতে হবে—রবিউল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়
বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করলেও তাদের কোনো সমাধান মেলেনি। এমনকি বিষয়টি নিয়ে মাউশির পক্ষ থেকে স্পষ্টীকরণের চিঠি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও আজও তার কোনো সদুত্তর দেয়নি মন্ত্রণালয়। যদিও একই ধরনের সমস্যা থাকলেও খুলনার একটি ডাবল শিফটভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ৮ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হয়েছেন।
পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষক সুমন পারভেজ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একেক সময় আমাদের একেক ধরনের কথা বলা হয়েছে। প্রথমে বলা হলো, নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে ডাবল শিফটের রুটিন তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়বে। পরবর্তীতে এনসিটিবি ডাবল শিফটের রুটিন প্রকাশ করলেও আমাদের এমপিওভুক্ত করা হয়নি। আমাদের মধ্যে অনেকেই অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ পেলেও শিক্ষকতার মহান পেশা ছাড়তে নারাজ ছিল। সেজন্য এখনো এ পেশায় রয়েছে। তবে আমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। একমাত্র এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে, এক বুক স্বপ্ন নিয়ে, এতদিন ধরে বেঁচে আছি। নতুন কারিকুলামকে সামনে এনে আমাদের পথে বসাবে এটি কোনো নিয়ম হতে পারে না। আমরা বিশ্বাস করি দেশের সকল মানুষ এখনও মনুষ্যত্ব হারায়নি, আমরা বিশ্বাস করি বিবেক জাগ্রত কিছু মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছে- যাঁদের সততা, মহানুভবতা ও ভাল মন্দের বিবেক চেতনায় ভর করে পৃথিবী আজও টিকে আছে, আমরা বিশ্বাস করি দেশের বিচার বিভাগ এখনও স্বাধীনতা হারায়নি। দ্রুত আমাদের সমস্যা দূর করে এমপিওভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি অল্প কিছুদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’