একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে নতুন শিক্ষাক্রমের বৈশ্বিক গুণ-মান অর্জন

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি ও মাউশির লোগো
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি ও মাউশির লোগো  © ফাইল ছবি

প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোয় আমূল পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে চলতি বছর সারাদেশে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শুরুতে নানা আলোচনা-সমালোচনার পর প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের কথাও জানানো হয়েছে দেশীয় শিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রচলিত পরীক্ষা ধারা, মূল্যায়ন, পাঠ্যসূচি ও বিভাগ বিভাজনের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষার আগ পর্যন্ত সুযোগ রাখা হয়েছে একই পাঠ্যসূচিতে পাঠদান করার। নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থী ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করাসহ নানা কারণে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বৈশ্বিক মানের নতুন এ শিক্ষাক্রম নিয়ে।

দেশের নতুন শিক্ষাক্রম সবার জন্য সমান করতে গিয়ে কমানো হয়েছে বিজ্ঞান ও গণিতের মতো প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতিসহ নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আবারও নতুন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। আর বিষয়টি নিয়ে এখনও দ্বিধায় রয়েছেন শিক্ষাবিদ ও দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তবে নতুন এ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, এটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রম হয়েছে। তবে তারাও স্বীকার করছেন নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ।

নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্য বইয়ের বাইরে গিয়ে জোর দেওয়া হয়েছে শিখন দক্ষতায়

বাংলাদেশের সর্বশেষ এ শিক্ষাক্রমটি আন্তর্জাতিক মানের হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, শিক্ষক সংকট, অবকাঠামো, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতা, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করাসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। শিক্ষক সংকটসহ নানা সংকটের কথা স্বীকার করছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও। আর নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের প্রচলিত শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের মূল কারিগর শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পঠন-পাঠন সম্পন্ন করতে পারেন সেজন্য শুরুতেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এতে শিক্ষাক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রমের তদারকি করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশগুলো তাদের বর্তমান শিক্ষাক্রমে জোর দিচ্ছে বিজ্ঞান, গণিত ও বাস্তব দক্ষতা উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোয়। আর প্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে দেশগুলো নজর দিয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শেখানোর ওপর। বাংলাদেশ ছাড়াও সাম্প্রতিককালে আলোচনায় এসেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে নানা পরিবর্তনও। দেশটির পাঠ্যসূচিতে নানা কাট-ছাঁট নিয়ে বিপরীত অবস্থার রয়েছে দেশটির সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে।

নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের শেখার জায়গাটিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে চাই। প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে একজন শিক্ষার্থীর যতটুকু সম্ভাবনা রয়েছে—তার পূর্ণ বিকাশ আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সেজন্য আমাদের পরিবর্তনকে স্বীকার করার এবং নতুন নতুন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মানসিকতা রাখতে হবে—শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সরকারের সাবেক একজন সচিব জানিয়েছেন, দেশে এর আগে নতুন যে গুচ্ছভিত্তিক বা মূল্যায়ননির্ভর কারিকুলাম-২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে; যার মাধ্যমে সৃজনশীল পদ্ধতি বাতিল হয়ে গেছে। এটি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ছিল। সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল এই ধারণা নিয়ে যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে অনেক বেশি সৃজনশীল হবে। কিন্তু ২০২২ সালে সৃজনশীল ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১৩৫টি দেশের মধ্যে ১২৯তম হয়েছে। ফলে দেশের বহুল কাঙ্ক্ষিত নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের নব-চেষ্টার সফলতা আনতে হলে দক্ষতার সাথে আমাদের আর্থ-সামাজিক সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি শিক্ষক সংকটের কারণেও শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হতে পারেন অভিজ্ঞতানির্ভর এ শিক্ষা কার্যক্রম হতে। এছাড়াও মূল্যায়নে শিক্ষকদের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রাপ্তি এবং তার সর্বোচ্চ ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এছাড়াও শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের এ শিক্ষাক্রমে ইতিবাচক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ বলে মত তাদের।

নতুন শিক্ষাক্রমে বিভিন্ন কাজের ওপর শিখন দক্ষতার ও মূল্যায়িত হবে শিক্ষার্থীরা

বদলে যাওয়া বিশ্বে পরিবর্তনকে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, জাপান কিংবা কোরিয়ার মতো দেশগুলো জোর দিচ্ছে শিক্ষার্থীর প্রাথমিক স্তরেই ভাষা, ভাষা শিল্প, গণিত, ইতিহাস এবং ভূগোলের মতো বিষয়ে। দেশগুলো পরবর্তী প্রজন্মে অর্থাৎ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় যুক্ত করে বিজ্ঞানের সাধারণ কাঠামো বা মানদণ্ড। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড জাতীয় পাঠ্যক্রমের আটটি স্তরবিন্যাসে শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেষ্টা করে নতুন একটি বিষয়। এটি গ্রেড ওয়ান থেকে শুরু করে দেশটি। সেখানে শিক্ষার্থীরা বাধ্যতামূলক এসব শিক্ষার ক্ষেত্র (বিষয়) পার করে সাধারণত ১৯ বছর পর উচ্চশিক্ষা কিংবা কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ পান।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায় এগিয়ে থাকা দেশ শ্রীলঙ্কায় উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের পূর্বে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় ভাষা, গণিত, পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়গুলো। এছাড়াও দেশটির শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি গ্রেড-৩ অর্থাৎ শিক্ষাকালের তৃতীয় বর্ষে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি এবং দ্বিতীয় জাতীয় ভাষা হিসেবে পড়ানো হয় সিংহলা বা তামিল। সাম্প্রতিককালে আর্থিক দৈন্যদশা কাটিয়ে ওঠা দেশটিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে মোট ছয়টি শিক্ষা ধারায় জোর দেওয়া হয় কলা, বাণিজ্য (অর্থনীতি), বিজ্ঞান (জীববিজ্ঞান), কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন (টিইডি), কৃষি, প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোতে।

দেশে এর আগে নতুন যে গুচ্ছভিত্তিক বা মূল্যায়ননির্ভর কারিকুলাম-২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে; যার মাধ্যমে সৃজনশীল পদ্ধতি বাতিল হয়ে গেছে। এটি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ছিল। সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল এই ধারণা নিয়ে যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে অনেক বেশি সৃজনশীল হবে। কিন্তু ২০২২ সালে সৃজনশীল ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১৩৫টি দেশের মধ্যে ১২৯তম হয়েছে—সরকারের সাবেক সচিব।

সাম্প্রতিককালে পাঠ্যসূচি নিয়ে আলোচনায় রয়েছে পাশের দেশ ভারতও। দেশটির নতুন পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিতে ‘বিবর্তনবাদ’, ‘পর্যায়বৃত্ত সারণি’ ও ‘শক্তির উৎসসহ বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দেওয়ার কারণে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এছাড়াও নতুন এ পরিবর্তনকে অস্বীকার করে রিট পিটিশন দাখিল করেছেন দেশটির হাজার হাজার মানুষ। এছাড়াও দেশটিতে কবি আল্লামা ইকবাল কিংবা পাকিস্তানি লেখকদের রচনা বাদ দেওয়া নিয়েও সমালোচনা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ধরা হয় ফিনল্যান্ডের বর্তমান ব্যবস্থাকে। বছরে দেশিটির একজন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে অন্তত ৭৪ বার পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা হয়। এজন্য শিক্ষার্থীদের পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয় শিক্ষককে। আর শিক্ষককে সেই মূল্যায়ন প্রধান শিক্ষকের কাছেও পাঠাতে হয়, প্রধান শিক্ষক সেটি পরীক্ষা করার পর সুপারিশ করে পুনরায় পাঠান শ্রেণি শিক্ষকের কাছেই।

নতুন শিক্ষাক্রমে থাকছে না অধিক হারে প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা

আর প্রযুক্তি ও কর্ম দক্ষতায় বিশ্বে এগিয়ে থাকা জাপানে শিক্ষার্থীদের উচ্চ বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয় জাপানি ভাষা, নাগরিক বিজ্ঞান, গণিত, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, কলা, বিদেশি ভাষা এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতির মতো বিষয়গুলো। সূর্যোদয়ের দেশটিতে ভূগোলের সাথে একীভূত করে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় ইতিহাসও।

বিপরীতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের নতুন পাঠ্যক্রমে মোট ১০টি বিষয় রাখা হয়েছে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। এর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতির মতো বিষয়গুলো পড়ানো হবে দেশের সকল শিক্ষার্থীকে। বিভাগ বিভাজনের পরিবর্তন এবং সকল শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণ বিজ্ঞান একীভূত করার ফলে সংকুচিত হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্র।

বদলে যাওয়া বিশ্বে পরিবর্তনকে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, জাপান কিংবা কোরিয়ার মতো দেশগুলো জোর দিচ্ছে শিক্ষার্থীর প্রাথমিক স্তরেই ভাষা, ভাষা শিল্প, গণিত, ইতিহাস এবং ভূগোলের মতো বিষয়ে। দেশগুলো পরবর্তী প্রজন্মে অর্থাৎ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় যুক্ত করে বিজ্ঞানের সাধারণ কাঠামো বা মানদণ্ড।

বদলে যাওয়া শিক্ষা কাঠামোয় শুরুতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম এবং বাকি শ্রেণিগুলোতে ২০২৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এই শিক্ষাক্রম চালুর লক্ষ্যে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের প্রচলিত শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের মূল কারিগর শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পঠন-পাঠন সম্পন্ন করতে পারেন সেজন্য শুরুতেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনারও উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। আর এতে শিক্ষাক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রমের তদারকি করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। 

বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমে জোর দেয়া হচ্ছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠদানকে। এতে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হওয়ার কথা রয়েছে। এতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। আর দুটিই থাকছে পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমে। পাশাপাশি বাদ দেয়া হয়েছে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও। যা শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে নতুন শিক্ষাক্রমে।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অধিক শেখার সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা

এর আগে গত ২০২১ সালের মে মাসে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধারাবাহিকভাবে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে।

নতুন নিয়মে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। 

নতুন শিক্ষাক্রমে জোর দেয়া হচ্ছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠদানকে। এতে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হওয়ার কথা রয়েছে। এতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। আর দুটিই থাকছে পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমে।

এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা রাখা হয়নি। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন বিষয় পড়তে হয়। আর একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি বর্তমানে ঠিক হয় নবম শ্রেণিতে গিয়ে।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণি ও ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য নির্ধারিত কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) চালু করা হবে। বিভিন্ন শ্রেণিতে তা পর্যায়ক্রমে চালু হবে পরের বছর থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষিত হবেন শিক্ষকরা

নতুন এ শিক্ষাক্রমে বিভাগ বিভাজন বাদ দিয়ে সবার জন্য সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগের ফলে সংকুচিত হয়েছে এ স্তরের বিজ্ঞান শিক্ষার আওতা। এতে বাদ পড়েছে উচ্চতর গণিতের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়ও। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার আওতা কমবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। বিজ্ঞান একটি বিশেষায়িত বিষয় জানিয়ে তিনি বলেন, এটি পড়তে হলে স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে হয়। তার অংশ হিসেবে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গণিত পড়তে হত।

‘‘একই সাথে তাদের পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানকে আলাদা বিষয় হিসেবে পড়ানো হতো। নতুন এই শিক্ষাক্রম আগে যারা আর্টস এবং কমার্স পড়তো তাদের সুবিধার জন্য উচ্চতর গণিত একদম বাদ দেওয়া হয়েছে। আর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানকে একত্রিত করে বিজ্ঞান নামক একটি বিষয় পড়ানো হবে। এতে আগের নিয়মে যারা আর্টস নিয়ে যা শিখতো নতুন কারিকুলামে তারা একটু বিজ্ঞান এবং একটু গণিত পড়বে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে আগের নিয়মে বিজ্ঞানের ছাত্ররা যা শিখত প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে তারা বিজ্ঞান অনেক কম শিখবে।’’

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষক সংকট, মূল্যায়নে শিক্ষকদের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রাপ্তি এবং তার সর্বোচ্চ ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এছাড়াও শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের এ শিক্ষাক্রমে ইতিবাচক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, বিনিময়ে তারা নতুন শিখবে জীবন জীবিকা। আগের নিয়মে যারা বিজ্ঞান পড়তো তারা তো এসএসসি শেষে পড়াশুনা বাদ দিয়ে কিছু করে খাওয়ার জন্য পড়বে না। তাদের লক্ষ্য তো বিজ্ঞানী হওয়া। তাহলে তাদেরকে কেন বিজ্ঞান শেখানোর পরিবর্তে কারিগরি বিদ্যা শেখানো হবে? অন্যদিকে প্রযুক্তি নামক বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল যে এটা এখন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শ্রেণীতে পড়ানো হবে। আগে বিজ্ঞান না শিখে কেউ কি প্রযুক্তিবিদ হতে পারবে?

এটি আমরা এখন বুঝতে পারছি না; ১০ বছর পর বুঝতে পারবো। ঠিক যেমন পিইসি-জেএসসি ইত্যাদি চালু করে কুফল বুঝতে পারছি। সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে আমরা যা করেছি তার কুফলও বুঝতে পারছি। এখন থেকে স্কুল কলেজেই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। ঠিক যেমন সৃজনশীল শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের অবতারণা করে বিপর্যয় এনেছি তেমনি মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন না করে ধারাবাহিক মূল্যায়ন সিস্টেমের ফলে শিক্ষকরা এলাকার রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তাদের আরো বেশি করে চাপের মুখে পড়বেন। শিক্ষকদেরকে ব্যবহার করে সমাজকে আরো দুর্নীতিগ্রস্ত করার একটা পাঁয়তারা—যুক্ত করেন পদার্থবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেছেন শিক্ষামন্ত্রী

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির একাধিক সদস্য দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রম আন্তর্জাতিক মানের হয়েছে। তবে এখানে আপদকালীন পরিবর্তনের কোনো ধারণা না থাকায় কোভিডসহ নানা সংকট নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের জানান দিচ্ছে। এছাড়াও নতুন এ শিক্ষা মাধ্যমে অভিভাবকদের খুব বেশি সম্পৃক্ত না করার ফলে একটি দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বলেও অভিমত তাদের। নতুন কিছু করতে গেলে বাঁধা আসবে জানিয়ে তারা বলছেন, পরিবর্তনকে স্বীকার করতে আমাদের ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। এছাড়াও নতুন শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন করতে জোরদার নজরদারি, তদারকি এবং সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন দক্ষতা উন্নয়ন করতে কাজ করার পরামর্শ তাদের।

শিক্ষক সংকটসহ নতুন শিক্ষাক্রমে নানা চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, শিক্ষক সংকট কাটাতে আমরা নতুন করে এনটিআরসিএ এবং পিএসসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ অব্যাহত রেখেছি। শিক্ষক সংকট সব শিক্ষাক্রমের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে আমরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করবো বা বসে থাকব না—আমাদের যা কিছু আছে, তা নিয়েই আমরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। 

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, আমাদের পরিবর্তনকে স্বীকার করার মানসিকতা রাখতে হবে। সাথে নতুন নতুন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মানসিকতাও রাখতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা শিক্ষার্থীদের শেখার জায়গাটিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে চাই। প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে একজন শিক্ষার্থীর যতটুকু সম্ভাবনা রয়েছে—তার পূর্ণ বিকাশ আমরা নিশ্চিত করতে চাই।


সর্বশেষ সংবাদ