‘সংজ্ঞা অনির্ধারিত’ রেখে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন সম্ভব নয়

বাংলাদেশ সরকার
বাংলাদেশ সরকার  © লোগো

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তাদের সরকার পরিচালনার গোড়ার দিকে দেশকে শতভাগ স্বাক্ষরতার আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুত হিসেব মতে, বিগত ২০১৫ সালে তা শতভাগ হওয়ার কথা থাকলেও তারও প্রায় দশক পর বাংলাদেশের অর্জন ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ সাক্ষরতা। বর্তমানে দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ নাগরিক এখনো স্বাক্ষরতার মতো দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটেসটিক ২০২২’ অনুযায়ী দেশে বর্তমান স্বাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক আট শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর—জানিয়েছে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এছাড়াও দেশে বিভেদ রয়েছে স্বাক্ষরতার হার ও তার সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়েও। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞানুযায়ী, স্বাক্ষরতা হচ্ছে পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে এবং লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। অর্থাৎ স্বাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়। স্বাক্ষরতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের পঞ্চম শ্রেণি পাস করা শিক্ষার্থীর সমমানের হতে হবে বলে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: দেশে বাড়ছে ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা 

বিপরীতে দেশে স্বাক্ষরতার হার গণনায় যে জরিপ করা হয় তা ‘সেলফ রিপোর্টেড’। অর্থাৎ সেখানে বিবিএসের মাঠকর্মীরা জানতে চান, আপনি লিখতে পারেন কি না? উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলেই তাকে সাক্ষর হিসেবে ধরা হয়। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের ‘টেস্টেড লিটারেসি’ জরিপের সাথে সাংঘর্ষিক। এতে দেশে স্বাক্ষরতার হার আরও কম হবে এবং নির্ধারিত সময়ে এ হার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছানো অসম্ভব বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চলমান সমস্যার সমাধানে আমাদের শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই জোর দিতে হবে। পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের মতো কার্যক্রমগুলো আমাদের সমাধান দিতে পারে। এজন্য আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করলেই শতভাগ স্বাক্ষরতা অর্জন সম্ভবমো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে বিগত ২০১৮ সালে স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ২০২০ সালে ছিল ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালেও স্বাক্ষরতার হার একই ছিল। এরপর সর্বশেষ ২০২২ সালে দেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ বলেও জানানো হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। 

অর্থাৎ দেশে গত পাঁচ বছরে দেশে স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে স্বাক্ষরতার বৃদ্ধির এ প্রবণতা সন্তোষজনক নয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশে স্বাক্ষরতার হার শতভাগ উন্নীতে আরও ২৬ বছর সময় লাগবে এবং এর ফলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারের নতুন নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তারা।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বৃদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি কতটুকু বেড়েছে?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাক্ষরতার হার বাড়ানোর মূল দায়িত্ব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর। কিন্তু তাদের একমাত্র প্রকল্প ‘মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা)’-এর মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তা শেষ করে দেওয়া হয় চলতি বছরের জুনে। ফলে কোনো ধরনের কাজকর্ম ছাড়াই দিন পার করছেন তারা। 

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার উদ্যোগে (ইউনেস্কো) এ বছর ‘পরিবর্তনশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে স্বাক্ষরতার প্রসার’—এ প্রতিপাদ্যে প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হবে। তবে দেশে সংশ্লিষ্ট ও মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে নানা আলোচনা ও তোড়জোড় দেখা যায় আন্তর্জাতিক এ দিবসটি আসলে। বিপরীতে দেশে যে গতিতে স্বাক্ষরতা কার্যক্রম চলছে তাতে এ সময়ের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই নিরক্ষরমুক্ত করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

২০১৮ সালে দেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ২০২০ সালে ছিল ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালেও স্বাক্ষরতার হার একই ছিল। এরপর সর্বশেষ ২০২২ সালে দেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশবাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে বিগত ২০১৮ সালে দেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ২০২০ সালে ছিল ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালেও স্বাক্ষরতার হার একই ছিল। এরপর সর্বশেষ ২০২২ সালে দেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ

দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলছেন, গত জুনে আমাদের একমাত্র প্রকল্প নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। বিভিন্ন জেলা কর্মকর্তার পদও শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে আছে। বিভিন্ন পর্যায়ে কম্পিউটার অপারেটর ও অফিস সহায়ক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেও তা স্থগিত রয়েছে। স্বাক্ষরতার হার বাড়াতে ব্যুরো থেকে একাধিক প্রকল্প প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন: র‍্যাংকিংয়ে ভারত-পাকিস্তানের ধারেকাছেও নেই বাংলাদেশ

বর্তমানে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫-এর আওতায় ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের বিদ্যালয় বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পিইডিপি-৩ থেকে আসা এক লাখ বিদ্যালয় বহির্ভূত শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে। অবশিষ্ট ৯ লাখের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় আট লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ২৫ হাজার ৭১২টি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে পাঠদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

১৯৭১ সালে দেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ১৯৯০ সালে ৩৫ দশমিক তিন শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৮ দশমিক ছয় শতাংশ, ২০২০ সালে স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৫ দশমিক ছয় শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অর্জনের অন্যতম শর্ত দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করা। কিন্তু সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং বাংলাদেশে স্বাক্ষরতা কার্যক্রম আরও সীমিত হয়ে এসেছে। বিশাল এই নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে স্বাক্ষর করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংজ্ঞা অনির্ধারিত রেখে সম্পূর্ণ স্বাক্ষরতা অর্জন সম্ভব নয় জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, প্রাথমিক স্তরেই আমাদের শিক্ষার ভিত্তি গড়ে ওঠে সেখান থেকেই আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের এখানে ‘কার্যকর স্বাক্ষরতা’ নিশ্চিত করতে হলে অর্থাৎ বাংলায় একটি অনুচ্ছেদ লিখতে পারা এবং পড়তে পারা নিশ্চিত করতে হবে—এখানে তা হচ্ছে না।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও অর্জিত হয়নি শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত গুণগত মান

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষক বলেন, ফাংশনালি লিটারেট বা কার্যকরভাবে স্বাক্ষর তাকেই বলা যায়, যিনি মাতৃভাষায় তার দৈনন্দিন জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি অনুচ্ছেদ বা বিবৃতি পাঠ করে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেন এবং একটি অর্থবোধক অনুচ্ছেদ বা বিবৃতি লিখতে পারেন। একইসাথে দৈনন্দিন জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিক গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করতে পারাও স্বাক্ষরতার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

চলমান সমস্যার সমাধানে আমাদের শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই জোর দিতে হবে। পাশাপাশি আরও জোর দিতে হবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মতো কার্যক্রমগুলোয়। বর্তমানে এ ধরনের কার্যক্রমগুলো অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গণস্বাক্ষরতা অভিযানের মতো কার্যক্রমগুলোও আমাদের সমাধান দিতে পারে। এজন্য আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করলেই শতভাগ স্বাক্ষরতা অর্জন সম্ভব—যুক্ত করেন মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।


সর্বশেষ সংবাদ