ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলা: বাংলার স্বাধীনতার প্রতীক ও ভাটিরাজ্যের স্থপতি

সোনারগাঁওয় জমিদার বাড়ি
সোনারগাঁওয় জমিদার বাড়ি  © সংগৃহীত

ষোড়শ শতকের বাংলা—যখন মুঘল সাম্রাজ্যের ছায়া ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছিল, তখন পূর্ব বাংলার নদীবেষ্টিত জনপদে গড়ে উঠেছিল এক সাহসী প্রতিরোধের দুর্গ। এর নেতা ছিলেন এক দুরদর্শী, কৌশলী ও দেশপ্রেমিক শাসক—ঈশা খাঁ। ইতিহাস, জনশ্রুতি ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের সম্মিলনে ঈশা খাঁ ও সোনারগাঁও একে অপরের পরিপূরক নাম হয়ে উঠেছে। আজও তাঁর শাসন, সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

উত্থানের শুরু
১৫২৯ সালের ১৮ আগস্ট আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন ঈশা খাঁ। তাঁর পিতা কালিদাস গজদানী ছিলেন সে সময়ের এক মুসলিম শাসকের সভাসদ। ইসলাম ধর্মের ন্যায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ধর্মান্তরিত হন। পিতার মৃত্যুর পর ঈশা খাঁর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন তাঁর পিতৃব্য কুতুবউদ্দীন খাঁ। ১৫৫১ সালে ঈশা খাঁ সরাইলে এসে শাসনকার্যে প্রবেশ করেন।

সোনারগাঁওয়ে জমিদারি ও শাসনযাত্রা
১৫৬৪ সালে, ৩৫ বছর বয়সে, কররাণী শাসকদের অধীনে তিনগুণ মোহর প্রদানের শর্তে তিনি সোনারগাঁও ও মহেশ্বরদী পরগণার জমিদারি লাভ করেন। ১৫৭৫ সালে দাউদ খানের আনুগত্য স্বীকৃতির মাধ্যমে তিনি ‘মসনদ-ই-আলা’ উপাধি অর্জন করেন। একই বছরে রাজা টোডরমলের ভূমি বিক্রয় নীতির সুযোগে ঈশা খাঁ নিজ জমিদারি বৈধভাবে ক্রয় করেন—যা তাঁকে আরও দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান দেয়।

এই সময় থেকেই বারো ভূঁইয়ার মধ্যে ঈশা খাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজধানী ও সামরিক প্রস্তুতি
ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল তিনটি—কাত্রাভু, সোনারগাঁও এবং জঙ্গলবাড়ি (বর্তমান কিশোরগঞ্জ)। ১৫৮১ সালে তিনি প্রশাসনিক কেন্দ্র সরাইল থেকে সোনারগাঁওয়ে স্থানান্তর করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রংপুর, বগুড়া ও পাবনার অংশজুড়ে তাঁর শাসন বিস্তৃত ছিল। তিনি ২২টি পরগণার অধিপতি ছিলেন।

নদীকেন্দ্রিক ভূপ্রকৃতির সুবিধা কাজে লাগিয়ে ঈশা খাঁ গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী নৌবাহিনী ও জলদুর্গ, যা তাঁকে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাঁর শাসনব্যবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে ন্যায়নিষ্ঠ, জনবান্ধব এবং প্রশাসনিক দক্ষতায় পরিপূর্ণ।

ভালোবাসা ও নামের গল্প
ঈশা খাঁ বিবাহ করেন বিক্রমপুরের রাজা চাঁদ রায়ের কন্যা ও কেদার রায়ের বোন স্বর্ণময়ীকে। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাঁর নাম হয় সোনা বিবি। জনশ্রুতি রয়েছে, প্রিয় স্ত্রী সোনা বিবির নামানুসারে তিনি রাজধানীর নাম রাখেন ‘সোনারগাঁও’। যদিও ‘সোনারগাঁও’ নামটির ঐতিহাসিক উৎস বিতর্কিত, তবুও এই কাহিনি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
১৫৫৬ সালে আকবর সিংহাসনে বসেন এবং ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। তবে বাংলার বড় একটি অংশ বারো ভূঁইয়ার অধীনে ছিল। ঈশা খাঁ ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত ও প্রভাবশালী। মুঘল সেনাপতি মানসিংহের বিরুদ্ধে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধ হয় ১৫৯৭ সালে, যেখানে ঈশা খাঁ নদীনির্ভর প্রতিরক্ষা ও বিচক্ষণ সামরিক কৌশলের মাধ্যমে মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করেন।

আকবরের দরবারি ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁকে ‘মারজুবানে ভাটি’ বা ভাটির শাসক বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহের পূর্বাংশ, ত্রিপুরা ও সিলেটের পশ্চিমাংশ এবং রংপুর-শেরপুর অবধি।

সহনশীলতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি
ঈশা খাঁর শাসন ছিল ধর্মীয় সহনশীলতায় অনন্য। হিন্দু কন্যা সোনা বিবির সঙ্গে বিবাহ, পানাম নগরের হিন্দু ব্যবসায়ীদের নিরাপদ আবাস প্রদান, ধর্মীয় সংঘাত থেকে বিরত থাকা—এসবই প্রমাণ করে তিনি ছিলেন এক উদার, ধর্মনিরপেক্ষ শাসক। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি পাঠশালা ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায়ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

ঐতিহ্যের নগরী পানাম
ঈশা খাঁর রাজধানী সোনারগাঁওয়ের পাশেই গড়ে ওঠা পানাম নগর পরবর্তীকালে তুলা ও মসলিন বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৮–১৯শ শতাব্দীর নান্দনিক স্থাপত্যে নির্মিত এই নগরীর বাড়িগুলোতে বসবাস করতেন ধনী হিন্দু ব্যবসায়ীরা। আজও পানাম নগর বাংলার বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক।

অন্তিম সময় ও উত্তরাধিকার
৫৩ বছর শাসন ও সংগ্রামের পর ঈশা খাঁ ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বক্তারপুর দুর্গে ইন্তেকাল করেন। তাঁর সমাধি গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর গ্রামে অবস্থিত, যা ঈশা খাঁ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত।

ঐতিহ্যের প্রতীক
ঈশা খাঁ শুধুমাত্র একজন সামন্তপ্রভু ছিলেন না—তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম সংগঠিত স্বাধীনতার প্রতিরোধের রূপকার। বারো ভূঁইয়ার নেতা, কৌশলী সেনাপতি, দূরদর্শী শাসক এবং সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে ঈশা খাঁর নাম বাংলার ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। তাঁর সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা আজও প্রগতিশীল বাংলাদেশের মূলে প্রোথিত।


সর্বশেষ সংবাদ