৩ বিভাগে ১৩ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করে শাবিপ্রবি

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। ডিজিটাল বাংলাদেশে অন্যতম ডিজিটাল ক্যাম্পাস সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এখন পর্যন্ত গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে মাধ্যমে দেশের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তৈরি করেছে অনন্য অবস্থান।

সিলেটবাসীদের দীর্ঘ ৭০ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে ও সিলেটের কৃতী সন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর অনবদ্য অবদানে ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর ১৯৮৬ সালের ২৫ আগস্ট সিলেট শহরের প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে কুমারগাঁওয়ে ৩২০ একর জমির ওপর শাবিপ্রবির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।

এর পর ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩টি বিভাগ, ১৩ জন শিক্ষক ও ২০৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে গুটি গুটি পায়ে দীর্ঘ ৩১ বসন্ত পেরিয়ে ৩২-এ পদার্পন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

অবকাঠামোগত দিক দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুটি প্রশাসনিক ভবন, ছয়টি অ্যাকাডেমিক ভবন, তিনটি ছাত্র হল, দুটি ছাত্রী হল, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ইউনিভার্সিটি ক্লাব, ইউনিভার্সিটি সেন্টারসহ কয়েকটি ভবনের পাশাপাশি নির্মাণাধীন রয়েছে কয়েকটি ভবন।

গুচিয়েছে সীমানা প্রাচীরের অভাবে ঘটমান অনিরাপত্তা। বর্তমানে সাতটি অনুষদের অধীনে ২৭টি বিভাগে ৫শ বায়ান্ন জন শিক্ষক এবং ১০ হাজার ২২ জন শিক্ষার্থী ১৩টি অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজে ৪ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আলোকোজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে চলছে দেশ-বিদেশে।

উদ্ভাবন, গবেষণা ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্ত সংস্কৃতির বাঁধনে এ সময়ের মাঝেই লাভ করেছে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে। প্রথম উপাচার্য হিসেবে ১৯৮৯ সালের ১ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকতা ছেড়ে হাল ধরেছিলেন ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী। যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, ভাষাসৈনিক, গবেষক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দক্ষ প্রশাসক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন।

মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তার অক্লান্ত পরিশ্রম, সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে যান তিনি। তিনি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো স্বনামধন্য শিক্ষকদের নিয়ে আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নেন।

আরও পড়ুন: ইমেরিটাস অধ্যাপক হতে চান না ড. জাফর ইকবাল দম্পতি

এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে উদ্ভাবন, গবেষণা ও সাফল্যে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন কওে চলছে শাবিপ্রবি। অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, একাধারে লেখক, পদার্থবিদ, শিক্ষাবিদ ও কথা সাহিত্যিক। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ১৯৯৩ সাল থেকে পথচলার শুরু থেকে ড. জাফর ইকবালকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন প্রথম উপাচার্য।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাকরি ছেড়ে ১৯৯৪ সালের ৪ ডিসেম্বর শাবিপ্রবিতে সিএসই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। স্বল্প সময়ের মধ্যে সারা বাংলাদেশের ভিতরে শাবিপ্রবির সিএসই বিভাগকে ব্র্যান্ডের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি শিক্ষকস্বল্পতা, অবকাঠামোগত-স্বল্পতা, অর্থের অভাবসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে সিএসই বিভাগকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনার আওতায় সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সেমিস্টার সিস্টেম চালু ও কম্পিউটারের ওপর কমপক্ষে দুটি কোর্স বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগও প্রতিষ্ঠিত হয় তার প্রচেষ্টায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবট, ড্রোন, সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা, মোবাইল ফোনে ভর্তিপ্রক্রিয়া, ই-পেমেন্টসহ তথ্যপ্রযুক্তির শাখায় নানা উদ্ভাবনে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অবদান অনস্বীকার্য। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর খ্যাতি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রভাব ফেলে। তবে ২০১৯ সালে ২৫ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতার জীবন শেষে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।

সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কের পার্শ্বস্থ প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সবুজ গাছ ও কোমল ঘাসের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সবার নজর কাড়ে। এক কিলোমিটার রাস্তার মাঝখানে দুই লেনকে আলাদা করে দাড়িয়ে আছে ছোট গাছ। দুই পাশজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের নয়নাভিরাম দৃশ্য। রাস্তার দুইলেনের দু’পাশে রয়েছে স্বচ্ছ পানির লেক। এতে রয়েছে নানান প্রজাতির মাছ ও বিস্তৃত পদ্ম আর শাপলার ফুল।

এক কিলোমিটার রাস্তা পেরোতেই আসে গোল চত্বর। গোল চত্বরের স্থাপনায় রয়েছে ফুলের বাগান ও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের গায়ে ইংরেজিতে ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখাটিকে ঘিরে ধরে তার সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে সবুজ ঘাস। সন্ধ্যা হতেই বৈদ্যুতিক আলোকে ঝলমল করে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি। এরই পাশে স্বাধীনতার গৌরবের মতোই মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে স্বাধীনতার মহান নায়ক বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল।

ম্যুরাল পেরিয়ে সামনে আসতেই বাম দিকে ছাত্রী হল ও ডানদিকে রয়েছে লাইব্রেরি ভবনসহ রাস্তার দুইপাশের শিক্ষাভবন। পাশেই রয়েছে ‘চেতনা ৭১’। ভাস্কর্যটিতে একটি ছেলে এক হাত উঁচু করে বাংলাদেশের পতাকা ধরে আছে। পাশে সহাবস্থানে একটি মেয়ের হাতে একটি বই, যা নির্দেশ করে বাংলাদেশের সংবিধান। ‘চেতনা ৭১’ দেখতে যেমন আধুনিক, তেমনি বর্তমান প্রজন্মের দেশপ্রেমকে উপস্থাপন করে প্রতীকীরূপে।

রাস্তার বামপাশ ধরে সামনে এগুলেই টিলার ওপরে নির্মিত ১০০ সিঁড়ি বিশিষ্ট দেশের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত এই শহীদ মিনার। এরই পাশে সবুজ গাছপালায় ঘিরে ধরা টিলাকে তার সৌন্দর্য্যরে ‘নিউজিল্যান্ড’ নাম দিয়েছে শিক্ষার্থীরা এবং এটি এ নামেই সিলেটের সর্বত্র পরিচিত। এছাড়া শাহপরান হল ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের পিছনের টিলাকে ‘অস্ট্রেলিয়া’ নামকরণ করেছে শিক্ষার্থীরা।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে শাবিপ্রবি। ১৯৯৯ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শাবিপ্রবি প্রথম ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক স্থাপন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম মুঠোফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া চালু, বিশ্বের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ উদ্ভাবন যা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তথ্য অনুসন্ধান করতে পারে এবং বর্তমানে সংবাদ পাঠ, লাইব্রেরি, কেনাকাটা, জব সার্চ, বাংলা বানান সংশোধনী ও শব্দকল্প ইত্যাদি যুক্ত করে তা আরও সমৃদ্ধ করা হয়েছে।

রোবট রিবো ও লি তৈরি, ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০১৮’-এ টিম অলিকের ‘বেস্ট ইউজ অব ডেটা’ ক্যাটাগরিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া, অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের নেতৃত্বে ৫ থেকে ১০ মিনিট সময়ের মধ্যে ৫০০ টাকার চেয়ে কম খরচে ক্যানসার শনাক্তকরণের সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একুশে বাংলা কিবোর্ড উদ্ভাবন, ট্র্যাকিং ডিভাইসের মাধ্যমে যানবাহনের লোকেশন ট্র্যাকিং, নিজেদের ড্রোন দিয়ে পাখির চোখে ক্যাম্পাস দেখা, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, অ্যামাজনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি শিক্ষকতা ও গবেষণায় মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন শাবিপ্রবির গ্র্যাজুয়েটরা।


সর্বশেষ সংবাদ