অপূর্ণাঙ্গ ছিল নিয়োগ বোর্ড
বশেমুরবিপ্রবিতে ‘ছাত্রী হয়রানি’তে অভিযুক্ত প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ
প্রার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বিভিন্নভাবে
- খাদিজা জাহান তান্নি
- প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:১৪ PM , আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৯ PM
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উচ্চশিক্ষালয়টি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে সুপারিশ করা হয়েছে ছাত্রী হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত এক প্রার্থীকে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালটির ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনা করে সংশ্লিষ্টরা এ নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। অভিযুক্ত প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে যোগ্য এবং ফলাফলে এগিয়ে থাকা প্রার্থীদের ‘অতিরিক্ত ক্লাস’ এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ খারাপ’ বলে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বোর্ডে থাকা প্রার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, গত ১৭ অক্টোবর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা ছিলেন। তবে তাদের নিয়োগের জন্য কোনো সুপারিশ করেনি নিয়োগ বোর্ড।
নিয়োগ বোর্ড থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয় মো. আহমেদ আলী নামে এক প্রার্থীকে। যিনি এর আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় ছাত্রী হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন এবং উক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই বিশ্ববিদ্যালয় তার সাথে চুক্তি বাতিল করে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজের নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, আমি ঘটনার সময় দায়িত্বে ছিলাম না। তবে এ বিষয়ে সম্প্রতি জানতে চাইলে আমি ওই বিভাগের তৎকালীন প্রধানের কাছে খোঁজ নেই এবং তিনি আমাকে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
আরও পড়ুন: মাভাবিপ্রবিতে শিক্ষক নিয়োগে উপাচার্যের ‘স্বেচ্ছাচারিতায়’ বাদ পড়েছেন যোগ্যরা
অভিযুক্ত আহমেদ আলী আমাদের পার্টটাইম শিক্ষক থাকা অবস্থায় এক ছাত্রী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। যেহেতু তিনি আমাদের পার্মানেন্ট শিক্ষক না তাই অভিযোগের পরপরই তার সাথে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলেও জানান তিনি।
এছাড়াও অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর সাথে ওই শিক্ষকের হোয়াটসঅ্যাপের আলাপচারিতার কিছু অংশও দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। হোয়াটসঅ্যাপের এসব আলাপচারিতায় অভিযুক্ত শিক্ষককে বিভিন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ ও অশালীন বার্তা দিয়েছেন ওই ছাত্রীকে।
যদিও অভিযুক্ত মো. আহমেদ আলীর দাবি তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী কোর্সে কিছু পরিবর্তন আসাতে আমিই ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে এসেছি।
এদিকে একই নিয়োগে আবেদন করা একাধিক প্রার্থীর জানিয়েছেন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ড. হাসিবুর রহমান তার পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ প্রদান করতে অতিরিক্ত ক্লাস (ক্লাস লোড) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশগত খারাপ অবস্থার কথা উল্লেখ করে তাদের ভাইভায় অংশগ্রহণকালে নিরুৎসাহিত করেছেন। এমনকি এক্সপার্ট মেম্বারদের একাংশকেও যথাযথভাবে বোর্ড আয়োজনের বিষয়ে জানানো হয়নি বলেও নিশ্চিত করেছেন তারা।
আরও পড়ুন: বেরোবিতে জোবেদার ‘ডাক না পাওয়া নিয়োগে’ শিক্ষক হলেন ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নিয়োগ বোর্ডে বর্তমানে এক্সপার্ট মেম্বার হিসেবে যে চারজন অধ্যাপক রয়েছেন তাদের মধ্যে বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক বশির আহমেদ, অধ্যাপক শামসুন্নাহার খানম। নিয়োগ বোর্ডে থাকা অধ্যাপক ড. খুরশিদা বেগম এবং অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন কিছু সময়ের জন্য অনলাইনে যুক্ত হতে সক্ষম হন। তবে অধ্যাপক ড. খুরশিদা বেগম এবং ড. মো. সোহরাব হোসেন জানান তারা দেরিতে বোর্ডের বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন বলে তারা থাকতে পারেনেনি।
বোর্ডে থাকা ড. খুরশিদা বেগম বলেন, আমি ব্যক্তিগত কারণে বোর্ডে থাকতে পারিনি তাই সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমার যতটা মনে পড়ছে তুলনামূলক দেরিতে আমাকে চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রার্থীদের সম্পর্কে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে যে সময় প্রয়োজন তখন ততটা সময় ছিল না।
নিয়োগ বোর্ডে থাকা অপর সদস্য অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বলেন, পরীক্ষার বোর্ড বসার একদিন আগে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. হাসিবুর রহমান মুঠোফোনে বোর্ডের বিষয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন। নিয়োগ বোর্ডের বিষয়ে ১৫ দিন থেকে ১ সপ্তাহ আগেই রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে চিঠি এবং প্রার্থীদের বিস্তারিত পাঠানোর কথা। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আমাকে ড. হাসিবুর রহমান একদিন আগে মুঠোফোনে বোর্ডের বিষয়ে জানান। আমি তখন তাকে জানাই এত স্বল্প সময়ের নোটিশে গোপালগঞ্জে গিয়ে বোর্ডে অংশগ্রহণ সম্ভব নয় কারণ আমি এখনও প্রার্থীদের কোনো তথ্যই পাইনি।
তিনি বলেন, ড. হাসিবুর রহমানকে আমি তাড়াহুড়ো না করে এক সপ্তাহ পরে বোর্ড আয়োজন করতে বলি যাতে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। কিন্তু তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনসহ শিক্ষক স্বল্পতাকে কারণ হিসেবে দেখায় এবং আমাকে অনলাইনে যুক্ত হতে বলেন। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করলে তারা দাবি করো আমাকে কাগজপত্র পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি তখনতো দূরের বিষয় এখনও কাগজ পাইনি, শুধু মেইলে জুম লিংক পেয়েছিলাম।
আরও পড়ুন: নিয়োগ প্রার্থীকে ডাকার ‘নকল কল লিস্ট’ সাজাল বেরোবি
কিন্তু আমি যখন অনলাইনে যুক্ত হতে যাই প্রথম ৪০ মিনিট হোস্ট জয়েনিং ওপেন করেননি এবং আমি যুক্ত হতে পারিনি। যখনই যুক্ত হই তখন বেশ কয়েকজনের ভাইভা শেষ। পরবর্তীতে আমি যখন বোর্ড শেষে মতামত দিতে যাই এবং তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করি তখন আমাকে বলা হয় আপনিতো শুরু থেকে ছিলেন না তাই আপনার মতামত নেয়া যাবে না। সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছি নিয়োগ বোর্ডটি সঠিকভাবে হয়নি—জানান নিয়োগ বোর্ডে থাকা এ সদস্য।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ড. হাসিবুর রহমান বলেন, এক্সপার্টদের বলার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের, চেয়ারম্যানের নয়। তাই কাকে জানানো হয়েছে বা হয়নি—এ বিষয়ে আমি জানি না। আর নিয়োগ বাণিজ্যের কথা যেটা বলা হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. দলিলুর রহমান বলেন, আমরা সবকিছু নিয়মানুযায়ী করেছি। আর যৌন হয়রানির বিষয়টা আমরা মৌখিকভাবে শুনছি। এখনও লিখিত কিছু পাইনি। আমরা তো প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার তথ্য নেই, সেখানে এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে তথ্য থাকে না। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আমরা বিষয়টি খোঁজ নিব।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে উপাচার্য ড. একিউএম মাহবুব বলেন, আমরা যাকে নিয়েছি তার ফলাফল অত্যন্ত ভালো, দুটো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ভাইভায় ভালো করেছে এ কারণেই তাকে সুপারিশ করা। নিয়োগের ক্ষেত্রে ভাইভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজনের পিএইচডি থাকুক বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থাকুক সে যদি ভাইভাতে ভালো করতে না পারে আমরা তো তাকে নিয়োগ দিতে পারি না।