হাবিপ্রবিতে র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ছেন রিয়াদ, সানাউল্লাহরা

র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ছেন রিয়াদ, সানাউল্লাহরা
র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ছেন রিয়াদ, সানাউল্লাহরা  © সংগৃহীত

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছরই কেউ না কেউ র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ছাড়ছেন স্বপ্নের ক্যাম্পাস। এমনই ঘটনা ঘটে চলেছে হাবিপ্রবিতে। সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়েন স্থাপত্য বিভাগের সদ্য ভর্তি হওয়া ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান। এর আগেও অনেকেই ছেড়েছেন ক্যাম্পাস। 

গত বছর বরগুনার ২১ ব্যাচের ফিশারিজ অনুষদের সানাউল্লাহ্,। তার আগের বছর চট্টগ্রামের ২০ ব্যাচের এগ্রিকালচারাল এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শাহরিয়ার, তারও আগের বছরে নেত্রকোনার ১৯ ব্যাচের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিয়াম র‍্যাগিং সইতে না পেরে ছেড়েছেন হাবিপ্রবি। এছাড়াও অপ্রকাশিত অনেকেই আছেন যারা এই র‍্যাগিং এর কারণেই নীরবেই ছেড়েছেন ভর্তিযুদ্ধে জয় করা প্রাণের ক্যাম্পাস।

এসব নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে অগ্রজদের ম্যানারের বা ভদ্রতা শিখানোর নামে র‍্যাগিংয়ের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। মূলত বছরের পর বছর এভাবেই র‍্যাগিং ঐতিহ্য চলে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। প্রতিবাদ করলে নবীন শিক্ষার্থীকে বয়কটের নামে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় বন্ধুদের কাছ থেকে। সানাউল্লাহসহ নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা মনে করেন, যেসব শিক্ষার্থীরা নীরবে র‍্যাগিং সহ্য করেন তাদের মধ্যে অনেকই প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে নিজেদের অনুজ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় থাকে! মূলত এভাবেই র‍্যাগিংয়ের সংস্কার গড়ে উঠেছে হাবিপ্রবিতে।

নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সানাউল্লাহ বলেন, ক্যাম্পাসের পাশে নতুন মেস নিয়েছিলাম। হঠাৎ শুনলাম সন্ধ্যায় বড় ভাইরা ডেকেছে। ভাবলাম হয়তো বলবে ভার্সিটিতে কিভাবে চলতে হবে, তাদের সালাম দিতে হবে, এসব আরকি। আমরা ৯-১০ জন ছিলাম। ওনারা প্রথমেই সবাইকে লাইনে দাঁড়া করালো। এরপর শুরু হলো, এটা ওটা নিয়ে ভুল ধরা, মিলিটারী ভঙ্গিতে দাঁড় করানো, কথায় কথায় গালি-গালাজ, শূন্যের মধ্যে চেয়ারের ওপর বসাসহ নানান শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।পরবর্তীতে সানাউল্লাহ্ র‍্যাগিং সইতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল করে পরে ঢাকার একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন তিনি। 

১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফকির আলমগীর সিয়াম বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের দ্বিতীয় নামকরা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়তে এসেছি। সিনিয়র ভাইরা কাউকে টিকটিকি, কাউকে মুরগী বানিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মজা করতেন। স্ট্যাম্পের ওপর বসানো, কানে ধরিয়ে রাখা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুমের ক্ষেত্রফল নির্নয় করাসহ রাতভর আজগুবি সব স্টাইলের নির্যাতন করতেন বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়ররা। এখন নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি যেখানে না আছে হল সুবিধা , না আছে ক্যাম্পাসের তেমন কোনো সুবিধা। অশ্রুসজল চোখে ফকির আলমগীর সিয়াম আরও বলেন, আজও হাবিপ্রবিকে মিস করি। হাবিপ্রবির বন্ধুদের মিস করি। 

সবশেষে এবছরের ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর অভিযোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন আর্কিটেকচার বিভাগের ২২ ব্যাচের নবীন শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান। 

রিয়াদের বাবা মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে, টিউশনি করে, নিজের আয়ে ছেলেটা আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। সামান্য বেতনের চাকরি করে এক ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে এ কোন বিপদে পড়ল ছেলেটা। বড় ভাইদের সালাম না দিলে গায়ে হাত তুলবে, এটা কোন ধরনের আচরণ! সবাই লেখাপড়া করতে গিয়েছে, ভালভাবে থাকবে, লেখাপড়া করবে। তা না করে সন্ত্রাসী আচরণ করে—এটা তো ঠিক না।’

ছেলেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। অনেক বড় স্বপ্ন আমাদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ও মেধায় অনেক ভালো। কোনো দিন ওর মতের বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলিনি। রিয়াদ সব সময় তার ভালো–মন্দ নিজেই বিচার করেছে। সে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিতভাবে তার অসুবিধার কথা জানিয়েছে। এখন বিষয়গুলোর সমাধান হলে, শিক্ষকদের কাছে আশ্বাস পেলে ছেলেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার বিষয়ে রিয়াদ বলেন, ‘এখনো স্যারদের ওপরে ভরসা রেখেছি। চেয়ারম্যান স্যার ও প্রক্টর স্যার ফোন করেছিলেন। ফিরে যেতে বলেছেন। বাবার সাথে পরামর্শ করে পরে সিদ্ধান্ত নেব।’

আরও পড়ুন: সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও র‌্যাগিং বিরোধী ক্যাম্পেইন করবে ছাত্রলীগ

আর্কিটেকচার বিভাগের চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব মো. শাহরিয়ার বলেন, ইতোমধ্যেই আপনারা হয়তো জানেন যে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তার নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করবো। আমরা কখনোই চাই না কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এভাবে চলে যাক। আমরা তাকে ডেকেছি তাকে আশ্বস্ত করেছি আমরা তার প্রত্যেকটা বিষয় খুব সুক্ষ ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করবো। আমরা তাকে বোঝাতে চাই যে সে এখানে সম্পূর্ন নিরাপদ।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মামুনুর রশীদ বলেন, ওই শিক্ষার্থীকে আমি বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। আশাকরি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছি।

এদিকে র‍্যাগিং নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মেসগুলো টহল দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী র‍্যাগিং প্রমানিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি বহিষ্কার নির্ধারন করা হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ