নিয়োগ পেলেও রাবিতে যোগদান করতে পারেননি— ৩ বছর পর আলোচনায় ইন্দ্রনীল
- মারুফ হোসেন মিশন, রাবি
- প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪, ০৪:২৪ PM , আপডেট: ১০ জুন ২০২৪, ০৪:২৪ PM
অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণি ও এক বিষয়ে ফেল করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন— সম্প্রতি এমন একটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে ইন্দ্রনীল মিশ্র নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) সাবেক এক শিক্ষার্থীকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস না করে ওয়ার্ড কোটায় ভর্তি এবং পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। এরকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তিন বছর আগে ২০২১ সালের মে মাসে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান যে ১১ জন শিক্ষককে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে ইন্দ্রনীল মিশ্র নামের একজন নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রকৌশল অনুষদভুক্ত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। তবে যোগদানের আগেই তার সেই নিয়োগ অবৈধ ঘোষিত হয়েছিল। ফলে তিনি ওই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারেননি।
কর্তৃপক্ষ আরও বলছে, এ ঘটনার তিন বছর পর যারা না জেনে ইন্দ্রনীল মিশ্রের বিষয়টি ফেসবুকে শেয়ার করছেন এবং বর্তমান প্রশাসনকে দোষারোপ করছেন তাদের এসব মিথ্যা ও অপপ্রচার থেকে বিরত রাখতে অনুরোধ করা হচ্ছে। প্রশাসনের বক্তব্য, যদি নিয়ম ভঙ্গ করে কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে সকলে মিলে প্রতিবাদ করুন। তবে অপপ্রচার যেন না করা হয়।
জানা যায়, ‘অনার্সের কোর্স ফেল করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক!’ শিরোনামে ২০২১ সালের ১০ জুন একটি প্রকাশ করেছিল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। সেখানে বলা হয়েছিল, “ইন্দ্রনীল মিশ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তার পিতার নাম অধ্যাপক চিত্ত রঞ্জন মিশ্র। যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন সিনিয়র অধ্যাপক। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহানের সঙ্গে অধ্যাপক চিত্ত রঞ্জন মিশ্রের গভীর সখ্যতা ছিল। এছাড়াও ‘অবৈধভাবে’ শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়া ইন্দ্রনীল মিশ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পেলেও ‘ওয়ার্ড কোটায়’ ভর্তি হয়েছিলেন।”
এদিকে, প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, “ইন্দ্রনীল মিশ্র অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অর্জন করতে পারেননি। বরং দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে যে ১৪ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন, তার মধ্যে তিনি মেধাক্রম অনুযায়ী রয়েছেন দশম স্থানে। শুধু তাই নয়, তিনিই একমাত্র ছাত্র যিনি অনার্সের কোর্স-৪০৩ এ ফেল করেছিলেন। পরে আবার পরীক্ষা দিয়ে ওই বিষয়ে পাস করেন।”
জানা গেছে, গত সপ্তাহে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরপর থেকে কোটা পুনর্বহাল নিয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এতে সাধারণ ও কোটায় সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বিষয়ে ইন্দ্রনীল মিশ্রের নিয়োগটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান না করেও তিন বছর পর ফেসবুকে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন তিনি।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন ফেসবুকে লিখছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস না করে ওয়ার্ড কোটায় ভর্তি, তারপর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ইন্দ্রনীল মিশ্র। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই ছাত্র প্রথম বিভাগে পাশ তো করেননি, যে ১৪ জন শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলেন সেখানেও তার অবস্থান ১০ম। আবার তিনিই তার বিভাগে একমাত্র শিক্ষার্থী যে কিনা বিএসসিতে ৪০৩ কোর্সে ফেল করেছেন।
“মজার বিষয় হলো এই শিক্ষার্থী ফলাফল খারাপ হওয়ায় এমএসসিতে থিসিস গ্রুপে যাওয়ারই সুযোগ পাননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই) বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। আরো মজার বিষয় হলো ইন্দ্রনীল মিশ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারেননি। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কারণে ওয়ার্ড কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন।”
প্রবাসী শিক্ষক ও লেখক ড. আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি একজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই শিক্ষকের যোগ্যতা কি জানেন? সে প্রথম শ্রেণি পায়নি। দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়েছে যে কয়জন; এর মাঝে এই শিক্ষকের অবস্থান দ্বিতীয় শ্রেণিতেও সব চাইতে নিচের দিকে! এর চাইতেও মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই শিক্ষক নাকি বিশ্ববিদ্যালয়েই চান্স পেতেন না! বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন! সেই কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন!
“এই শিক্ষকের নিয়োগ হয়ত বাতিল হয়েছে। তবে নিশ্চিত জেনে রাখুন, এমন শিক্ষকের অভাব নেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এমন শিক্ষকরাই একদিন অধ্যাপক হবেন। এরপর পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনের টকশোতে যাবেন বিজ্ঞ মানুষ হিসেবে। হয়ত অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়েও কথা বলবেন। এটাই বাংলাদেশ।”
জানতে চাইলে রাবির ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই) বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মির্জা এ. এফ. এম. রাশিদুল হাসান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস বলেন, এটা সম্পূর্ণ ভুল ইনফরমেশন। ইন্দ্রনীল মিশ্র আইসিই বিভাগের কেউ নয়। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সোবহান ইন্দ্রনীলসহ ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে তিনি যোগদানের আগেই সেই নিয়োগ অবৈধ ঘোষিত হয়। ফলে তিনি এই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন একটি শিক্ষকও নিয়োগ দিতে পারেনি। এটা সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেটি প্রথা ভঙ্গ করে, নিয়ম ভঙ্গ করেই করা হয়েছিল। বর্তমান প্রশাসন এই নিয়োগের সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত না। ফলে এই ব্যাপারে বর্তমান প্রশাসনের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যারা না জেনে এগুলো হরহামেশাই শেয়ার করছে ও বর্তমান প্রশাসনকে দোষারোপ করছে তাদের বিনীতভাবে অনুরোধ করছি এসব মিথ্যা ও অপপ্রচার থেকে নিজেকে বিরত রাখতে। বরং সত্যটা তারা সকলে মিলে প্রচার করুক। যদি নিয়ম ভঙ্গ করে কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে সকলে মিলে প্রতিবাদ করুক। তবে অপপ্রচার করবেন না।
তিনি আরো বলেন, ইন্দ্রনীল মিশ্রসহ ওই সময়ে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সবাইকে অবৈধ পন্থায় নিয়োগ দেন তৎকালীস উপাচার্য, যা পরবর্তীতে অবৈধ ঘোষিত হয়। তারা এখন কেউই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন। এই অবৈধ নিয়োগের ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। তাই আমি আবারো অনুরোধ করছি, এভাবে অপপ্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না।
এ বিষয়ে কথা বলতে ইন্দ্রনীল মিশ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। সেজন্য তার বক্তব্যে নেওয়া সম্ভব হয়নি।