বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা, নীরবে চোখের পানি ফেলছেন শিক্ষকরা

লোগো
লোগো  © ফাইল ছবি

কুড়িগ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক নয়ন। ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ সুপারিশের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইনডেক্স নম্বর পেয়েছেন। তবে এখনো বেতন পাননি তিনি। নয়ন বলছিলেন, আর কিছুদিন পরই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। অন্য চাকরিজীবিরা পরিবার নিয়ে যেখানে ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন আমি বেতন কবে পাব তা নিয়ে দুশ্চিন্তায়। ইচ্ছে ছিল, এবার ঈদে বাবা-মা স্ত্রী-সন্তানকে একটা সুতো হলেও কিনে দেব। হলো না... দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলাম না।

মো. রাসেল ইব্রাহীম নামে আরেক শিক্ষক জানান, ‘গত সাত মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। বেতন পাই না, তা লজ্জায়ও বলতে পারছি না। বললে অনেকেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হাসাহাসি করবে। ঈদের জামাকাপড় কিনতে পারিনি, কবে কিনব জানি না। শিক্ষকতা পেশায় এসেছি স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু এখন দেখি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখার কেউ নেই, অভিভাবক থেকেও নেই।’

তার ভাষ্য, তাদের এই উদাসীনতার কারণে সামনে মেধাবীরা এই পেশায় আসার আগ্রহ দেখাবে না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের প্রতি ধিক্কার এবং বদদোয়া। মাউশি যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের শিক্ষাবান্ধব মনে হয় না। মাউশির বিতর্কিত কাজ জুলাইয়ের অর্জনকে ম্লান করে দেবে।

‘চার লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন অনলাইনে দেওয়া খুব সহজ বিষয় না। অনেকের তথ্যগত ভুল রয়েছে। তবুও মানবিক বিবেচনায় তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। নতুন একটি বিষয় বাস্তবায়ন করতে নানা সমস্যা হয়। সব সমস্যা সমাধান করে বেতন দেওয়ার কাজ চলছে। আমরা আমাদের কাজ শেষ করেছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদনও দিয়েছে। বাকি কাজ অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংকের। তাদের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বক্তব্য দিতে পারি না। কবে ব্যাংকে টাকা পাঠানো হবে সেটি চিফ অ্যাকাউন্টস অফিস ভালো বলতে পারবে’—অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান, মহাপরিচালক, মাউশি

শুধু এ দুই শিক্ষকনই নয়; বেসরকারি স্কুল-কলেজে কর্মরত পৌনে ৪ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী ঈদের আগে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন ও ঈদ উৎসব ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) বেতন-ভাতা ছাড় হলেও তা তুলবেন কবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শিল্পাঞ্চল এলাকার জন্য শুক্র ও শনিবার দুইদিন ব্যাংক খোলা থাকলেও সেটি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য প্রযোজন্য হবে কি না তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। এ অবস্থায় নীরবে চোখের জল ফেলছেন প্রায় চার লাখ শিক্ষক-কর্মচারী।

মাউশি জানিয়েছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। শিক্ষকদের তথ্যগত ভুলের কারণে বেতনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে তাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ব্যাংকে পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা পান। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগার থেকে ছাড় হলেও তা রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি ব্যাংকের মাধ্যমে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতে ছাড় হয়। এই অর্থ তুলতে শিক্ষকদের নানা ভোগান্তিতে পড়তে হতো।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ইএফটিতে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিওর বেতন-ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের ২০৯ জন শিক্ষক-কর্মচারীর অক্টোবর মাসের এমপিও ইএফটিতে ছাড় হয়। পরবর্তী সময়ে গত ১ জানুয়ারি ১ লাখ ৮৯ হাজার শিক্ষক ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতার সরকারি অংশের টাকা পেয়েছেন।

‘সমাজ ও পরিবারের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না। এভাবে আসলে আর চলতে দেয়া যায় না। তরুণ শিক্ষকরা এই বৈষম্য ও অবহেলা সহ্য করবে না। যদি আগামীকাল পর্যাপ্ত সময় হাতে রেখে বেতন বোনাস শিক্ষকদের একাউন্টে প্রেরণ না করা হয়, তাহলে লাখো এমপিও শিক্ষকরা আর বসে থাকবে না। কঠোর থেকে কঠোরতর কর্মসূচির মাধ্যমে ন্যায্য হিস্যা আদায় করবে। প্রয়োজন হলে মাউশি ঘেরাও কর্মসূচি দিতে বাধ্য থাকবে’—সান্ত আলী, সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ফোরাম

দ্বিতীয় ধাপে ৬৭ হাজার, তৃতীয় ধাপে ৮৪ হাজার এবং চতুর্থ ধাপে ৮ হাজার ২০০ এর অধিক শিক্ষক-কর্মচারীকে ডিসেম্বর মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা জানুয়ারি মাসের বেতনও পেয়েছেন। তবে তাদের ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন ও ঈদ উৎসব ভাতা এখনও হয়নি।

অন্যদিকে ৫ম ধাপে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এখনো ডিসেম্বর মাসের বেতন পাননি। গতকাল মঙ্গলবার এ ধাপের ৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের বেতনের মেসেজ পেয়েছেন। জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে এমপিওভুক্ত হওয়া প্রায় ৫ হাজার শিক্ষক এখনো বেতনের বাইরে রয়েছেন। এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টাকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জনিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীরা।

তারা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মার্চ মাসের বেতনও পেয়েছেন। বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের মার্চের বেতন ছাড় হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অবহেলায় স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা বেতন ভাতা পাচ্ছেন না। এর দায় সরকার কোনো ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না।

বাংলাদেশ শিক্ষক ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রভাষক মো. সান্ত আলী বলেন, ‘কয়েক লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বোনাস প্রদানে মাউশি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবেহলা আমাদেরকে চরমভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে সবসময় মাউশি গা-ছাড়া ভাব দেখিয়ে এসেছে। শিক্ষকরা যদি সরকারের আওতাভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে সরকারের ঘোষণা সত্ত্বেও ২৩ তারিখের মধ্যে বেতন বোনাস দেয়া হলো না কেন? শিক্ষকের ঈদ আনন্দ ইতোমধ্যে ম্লান হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘সমাজ ও পরিবারের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না। এভাবে আসলে আর চলতে দেয়া যায় না। তরুণ শিক্ষকরা এই বৈষম্য ও অবহেলা সহ্য করবে না। যদি আগামীকাল পর্যাপ্ত সময় হাতে রেখে বেতন বোনাস শিক্ষকদের একাউন্টে প্রেরণ না করা হয়, তাহলে লাখো এমপিও শিক্ষকরা আর বসে থাকবে না। কঠোর থেকে কঠোরতর কর্মসূচির মাধ্যমে ন্যায্য হিস্যা আদায় করবে। প্রয়োজন হলে মাউশি ঘেরাও কর্মসূচি দিতে বাধ্য থাকবে।’

মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান বলেন, ‘চার লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন অনলাইনে দেওয়া খুব সহজ বিষয় না। অনেকের তথ্যগত ভুল রয়েছে। তবুও মানবিক বিবেচনায় তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। নতুন একটি বিষয় বাস্তবায়ন করতে নানা সমস্যা হয়। সব সমস্যা সমাধান করে বেতন দেওয়ার কাজ চলছে। আমরা আমাদের কাজ শেষ করেছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদনও দিয়েছে। বাকি কাজ অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংকের। তাদের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বক্তব্য দিতে পারি না। কবে ব্যাংকে টাকা পাঠানো হবে সেটি চিফ অ্যাকাউন্টস অফিস ভালো বলতে পারবে।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence