রেলপথের জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে শেরপুরবাসীকে?
- আরফান আলী, শেরপুর
- প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:২২ PM , আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:২২ PM

বছরের পর বছর ধরে শোনা যাচ্ছে—শেরপুর জেলায় আসছে রেললাইন। কিন্তু বাস্তবে রেলগাড়ির বাঁশির শব্দ আজও শোনা যায়নি। স্বপ্নটা যেন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, নড়ে না, চড়ে না। জনমনে প্রশ্ন—রেলপথ আদৌ হবে তো? কবে হবে? আর কত প্রতিশ্রুতির গিলটি গিলতে হবে?
গারো পাহাড়ের পাদদেশে, সীমান্তবর্তী ছোট্ট জেলা শেরপুর। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক অঞ্চল। এক সময় এখানে ছিল এক হাজারের বেশি চালকল। এখন সেই জায়গা দখল করেছে আধুনিক অটো রাইস মিল। চালের পাশাপাশি এই জেলার বিশেষ পরিচিতি রয়েছে সবজি, খনিজ বালু, পাথর, কাঠ ও বাঁশ উৎপাদনে। এসব কৃষিপণ্য দেশের বাইরে পর্যন্ত রপ্তানি হয়, কিন্তু পরিবহনের ভরসা কেবল সড়কপথ।
এক সময়ের নৌপথ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এখনো নেই কোনো বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা। রেললাইন হলে এ অঞ্চলের কৃষি ও ব্যবসা খাত চাঙা হতো, সময় ও খরচ—দুই-ই কমত, বলছেন ব্যবসায়ী ও সাধারণ যাত্রীরা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, শেরপুর জেলায় রেলপথ স্থাপন করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার ত্রিশের দশকে প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। পরে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর রেলপথ স্থাপনের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে জামালপুর থেকে শেরপুরের ঝিনাইগাতীর বনগাঁ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সত্তরের দশকের শেষের দিকে তৎকালীন রেলওয়ে পুনরায় জামালপুর-রাংটিয়া ভায়া শেরপুর রেলপথ স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। সে কারণে স্বাধীনতার পর থেকেই শেরপুর-জামালপুর হয়ে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সে রেলপথের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের গ্যাড়াকলে আটকে ছিল ৪৩ বছর।
এরপর ২০১৪ সালের ৮ জুন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক জামালপুরের পিয়ারপুর রেলস্টেশনে আন্ত নগর তিস্তা ট্রেনের আনুষ্ঠানিক যাত্রাবিরতি উদ্বোধনকালে পিয়ারপুর থেকে শেরপুরে রেলপথ স্থাপনের ঘোষণা দেন। সেদিন মন্ত্রীর এ ঘোষণায় শেরপুর জেলাবাসীর মনে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর নতুন এক আশার আলো জেগে ওঠে। মন্ত্রীর ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জামালপুর জেলার পিয়ারপুর রেলস্টেশন থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর দিয়ে শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা হয়ে জেলা শহর পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার রেললাইনের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ চলছে।
এ জন্য ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই নতুন রেল সড়ক নির্মাণ করা হবে বলে এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ কিন্তু এরপর অদৃশ্য ছায়ায় ঢেকে যায় পিয়ারপুর-শেরপুর রেলপথ নির্মাণকাজ। একসময় ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাট উপজেলা হয়েও শেরপুর জেলাকে রেলপথ নেটওয়ার্কে আনার চিন্তাভাবনা চালানো হয়। এরপর কয়েক দফায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে নতুন রেলপথ নির্মাণ ও সম্প্রসারণ এবং রেলের নানা উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও পিয়ারপুর-শেরপুর রেলপথ স্থাপনের বিষয়টি কোনো আলোচনায় ওঠেনি।
তবে ২০২২ সালের মার্চে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রকল্প যাচাই কমিটির সভার সূত্র ধরে আবারও শেরপুরকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার বিষয়টি আলোচনায় ওঠে আসে। সে সময় ‘জামালপুর-শেরপুর-বকশীগঞ্জ হয়ে রৌমারীর দাঁতভাঙ্গা এবং জারিয়া-জাঞ্জাইল থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত ডুয়াল গেজ রেললাইন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং ডিটেইল ডিজাইন’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়।
শেরপুর জেলাসহ, পাশের জামালপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার আরো চারটি উপজেলার প্রায় ২৬ লাখ মানুষের এখন প্রাণের দাবি হয়ে উঠেছে শেরপুর জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শেরপুরে রেললাইন আসি আসি করেও আসছে না। জনমনে তাই প্রশ্ন উঠেছে, শেরপুরে রেলপথ, আর কত দূর? প্রতিবছর নির্বাচনের আগে শেরপুরের সাধারণ মানুষ জেলার উন্নয়ন নিয়ে আশায় বুক বাঁধে। এবার বুঝি রেল আসবে, মেডিক্যাল কলেজ হবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে, সীমান্ত জনপদে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে নাগরিকদের পক্ষ থেকে ওঠা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান না পাওয়ায় নির্বাচনের পর এসব ইস্যু বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে নানান উন্নয়ন মূলক কাজ হাতে নিয়েছে।
তাই আবারও নাগরিকদের পক্ষ থেকে শেরপুরে রেললাইন স্থাপন, মেডিক্যাল কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো আলোচনায় উঠে আসছে।
সর্বশেষ গতবছরে জামালপুর শহরের পাথালিয়া এলাকা থেকে শেরপুর সদর-শ্রীবরদী উপজেলা, বকশীগঞ্জ উপজেলা হয়ে রৌমারীর দাঁতভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পটি কিছুটা সংশোধন করার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে রেলওয়ের পরিকল্পনা সেলে পাঠানো হয়েছিল।
এ ব্যপারে স্থানীয় লোকজন জানায়, আমাদের শেরপুর জেলার সুনাম থাকলেও খুবই অবহেলিত। জেলায় বড় বড় নেতাকর্মী থাকতেও তেমন উন্নয়ন হয় নি। এখনো বিভিন্ন উপজেলার রাস্তাঘাট দেখলে মনে হবে শেরপুরে উন্নয়নের ছোয়াই লাগে নি। শেরপুর জেলার দিকে দৃষ্টি দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহবান জানান স্থানীয় ব্যক্তিবর্গরা।