‘ভয় হয়— পঙ্গু হয়ে গেলে চলমু কেমনে, ভাবলে ঘুম আসে না’
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫৯ PM , আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৪:১২ PM

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন মো. বেল্লাল ইসলাম (২০)। তার দু’পায়ে গুলি লাগে। চিকিৎসকরা গুলি অপসারণ করলেও এখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না তিনি। অভাবের কারণে উন্নত চিকিৎসা দূরে থাক, নিয়মিত ওষুধ কেনাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে তার পরিবারের জন্য। ফলে পঙ্গুত্বের আশঙ্কায় দিন কাটছে বেল্লালের।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া গ্রামের বাসিন্দা বেল্লাল ইসলাম। তার বাবা মো. আলাউদ্দিন গাজী পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক, আর মা সোসাম্মৎ নাজমা বেগম (৪৫) গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে বেল্লাল ছোট।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা নাজমা বেগম। তিনি বলেন, “আমার একটাই ছেলে। আজ সেই ছেলেটাই গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হওয়ার পথে। আমি তাকে নিয়ে কীভাবে বাকি জীবন কাটাব, তা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আমাদের অভাবের সংসারে এই ক্ষতি আর পূরণ হওয়ার নয়।”
২০২২ সালে এইচএসসি পাস করার পর আর্থিক অনটনের কারণে স্নাতকে (বিএ) ভর্তি হতে পারেননি বেল্লাল। তবে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ছয় মাস আগে ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে ছোটখাটো কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারের জন্যও আয় করছিলেন তিনি। রামপুরার টেলিভিশন ভবন এলাকার একটি নার্সিং হোমে চাকরি করতেন।
বেল্লাল জানান, ছাত্রদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। আন্দোলনের সব কর্মসূচিতেই তিনি অংশ নেন।
সবশেষ ৫ আগস্ট (সোমবার) গণ-অভ্যুত্থানের দিন, রাজধানীর প্রগতি সরণির মেরুলবাড্ডা এলাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো দিকে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার দু'পায়ে গুলি লাগে এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত কয়েকজন তাকে আফতাবনগরের নাগরিক স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে রোগীর ভিড়ে সেখানে জায়গা না পেয়ে তাকে একই এলাকার একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।
পরবর্তীতে তার বড় বোন আঁখি আক্তার খবর পেয়ে দুই দিন পর ছুটে আসেন এবং তাকে রাজধানীর বাসাবো এলাকার মাল্টিকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তার পা থেকে গুলি অপসারণ করেন। এরপর ৯ আগস্ট, বেল্লাল গ্রামের বাড়ি ফিরে যান।
বেল্লালের ডান পায়ের হাঁটুর নিচে বন্দুকের গুলি লেগেছে, আর বাঁ পায়ের গোড়ালির ওপরে ছররা গুলি বিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, “আমার ডান পায়ে যে গুলি লেগেছে, তা রাবার বুলেট কিংবা ছররা গুলি নয়, বরং তা আরও গুরুতর কিছু। ফলে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু অভাবের সংসারে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাবার পক্ষে ওষুধ কেনাই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ভয় হয়, পঙ্গু হয়ে গেলে কীভাবে চলব? আমাকে দেখার মানুষ কে? বাবা নিজেও অসুস্থ, আর আমি তো তাদের একমাত্র ছেলে। আমার কিছু হলে তাদের কী হবে? এসব ভাবলে রাতে ঘুম আসে না।”
বেল্লালের মা নাজমা বেগম বলেন, “আমার ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে মনে হয়েছিল যেন মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমাদের সংসার এমনিতেই অভাবের মধ্যে চলে, তার ওপর আমি আর ওর বাবা—আমরা দুজনেই অসুস্থ। ছেলেটা এখন বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছে, কিন্তু ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করার সামর্থ্য আমাদের নেই।”
তিনি জানান, আহত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ সর্বপ্রথম কিছু আর্থিক সহায়তা দেন। স্থানীয়ভাবে কয়েকজনও সামান্য সাহায্য করেছেন। তবে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সরকারের কাছে সন্তানের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে নাজমা বেগম বলেন, “আমার ছেলের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক সরকার। আর যদি তাকে একটা সরকারি চাকরি দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের জীবন কিছুটা স্বস্তির মধ্যে কাটবে।”
সূত্র: বাসস