বেতন ১২ হাজার টাকা, শিক্ষকতায় আগ্রহ দেখান না মেধাবীরা

ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক
ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক  © ফাইল ছবি

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদানের সময় একজন শিক্ষকের বেতন ধরা হয় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। স্বল্প বেতন হওয়ায় এই পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছেন তরুণরা। এর ফলে বেসরকারি স্কুল-কলেজে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকট লেগেই থাকছে। বেতন কম হওয়ায় মেধাবীরা এ পদে চাকরির জন্য আবেদনই করেন না। তবে কলেজ পর্যায়ের প্রভাষক পদে বেতন ভালো হওয়ায় এই পদে চাকরির আগ্রহ রয়েছে মেধাবী তরুণদের।  

জানা গেছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন সহকারী শিক্ষকের প্রারম্ভিক মাসিক বেতন সবমিলিয়ে ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। এর মধ্যে বাড়ি বাড়া ১ হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা। এ অর্থ  দিয়ে নিজের খরচ চালাতেই হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের। সেখানে পরিবারের হাল ধরা দুঃস্বপ্নের মতো। এ অবস্থায় শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আশার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন অনেকে। 

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে আইসিটি বিষয়ে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন সনদ অর্জন করেছিলেন মো. জাহাঙ্গীর। তবে বেতন কাঠামোর কারণে তিনি চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে চাকরির আবেদনই করেননি।

জাহাঙ্গীর বলেন, ১১তম গ্রেডে বেতন দেওয়া হয় ১৮ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই একটি পরিবার চলতে হিমশিম খায়। সেখানে ১২ হাজার টাকা বেতন দিয়ে সংসার চালানোর কথা কল্পনাই করা যায় না। শিক্ষক হওয়ার আগ্রহ থাকলেও বেতন কাঠামোর জন্য শেষ পর্যন্ত এই পেশায় যোগদান করিনি। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. অফসার বলেন, আমি ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে একটি প্রতিষ্ঠানে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। তবে সেটি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, তাতে ১২ হাজার টাকা দিয়ে কিছুই হবে না। তাই সুপারিশ পেলেও শেষ পর্যন্ত যোগদান করিনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন কম বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট রয়েছে বিষয়টি তেমন নয়। যে পদগুলো ফাঁকা রয়েছে তার অধিকাংশই নারী কোটার। এছাড়া অনেক বিষয়ে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। এ কারণে পদগুলো ফাঁকাই রয়ে যায়।

দায়িত্বশীলরা জানান,বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন আরও কম ছিল।  ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছয় লাখ শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের বেতন একেবারে বৃদ্ধির সক্ষমতা সরকারের রয়েছে কি না সেটিও দেখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা চলছে। এ অবস্থায় শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। প্রতিষ্ঠানটি দুটি বড় গণবিজ্ঞপ্তিতেও শিক্ষক সংকট দূর করতে পারেনি।

সংস্থাটি সবশেষ ২০২২ সালের শেষ দিকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। এ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনযোগ্য প্রার্থী ছিলেন দেড় লাখের বেশি। যোগ্য প্রার্থী থাকলেও অর্ধেক পদই পূরণ করতে পারেনি এনটিআরসিএ।

এর আগে ২০২১ সালে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অর্ধ লাখের বেশি শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল সংস্থাটি। তবে সেবারও প্রায় ২০ হাজার পদে কোনো প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করতে পারেনি তারা।

চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে একজন ব্যক্তির চলাই কঠিন; সেখানে এই অর্থ দিয়ে একটি সংসার চালানো কেবল কষ্টসাধ্যই নয়, বরং খানিকটা অসম্ভবও বটে। এ হিসাব কেবল নিজ বাড়িতে অবস্থান করে আশপাশের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা একজন শিক্ষকের। কিন্তু যাঁরা নিজ জেলার বাইরে অনেক দূরে চাকরি করছেন, তাঁদের হিসাবটা  মেলানো আরও কঠিন।

তারা বলছেন, শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর মাসিক বেতন দিয়ে সংসার চালানোর অঙ্ক মেলাতে না পেরে অনেক শিক্ষক মানসিক অশান্তিতে ভুগছেন। এ শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে মানসম্মত পাঠদান ও উন্নত শিখন কার্যক্রম। এ যেন ‘তেলেও কম, ভাজাতেও মচমচা’–এর নামান্তর। 

মোছা. রুমি বেগম বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ অর্জন করেছিলাম। তবে সহকারী শিক্ষকদের যে বেতন তা দিয়ে নিজের চলাই কষ্টকর। সেখানে পরিবারকে সহযোগিতা করবো কীভাবে। মা-বাবা অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়ালেখা করিয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে তাদের হাল ধরতে না পারলে আমার এই পড়ালেখার কোনো মূল্য নেই। তাই এনটিআরসিএ’র কোনো গণবিজ্ঞপ্তিতেই আবেদন করিনি।

এ তরুণী আরও জানান, উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের বেতন অনেক বেশি। আর আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন একজন কর্মচারীর চেয়েও কম। শিক্ষকদের মূল্যায়ন না করা হলে জাতি হিসেবে আমরা কখনোই সভ্য হতে পারবো না। শিক্ষক সংকটও দূর হবে না।

মো. আবদুল্লাহ নয়ন নামে এক শিক্ষক জানান, আমি নিজ বাড়ি থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। আমার বেতন ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। এই টাকায় ঘড় ভাড়া, বাড়িতে যাতায়াত নিজের খরচ চালিয়ে পরিবারকে ৩ হাজার টাকাও পাঠাতে পারি না।

অথচ আমার ওষুধ এবং বাচ্চার দুধ খরচ মাসে ৬ হাজার টাকা। পরিবারের খাবার খরচ এখন বোঝার ওপর শাকের আটি। ভাবছি পেশা বদল করে অন্য কোনো চাকরিতে ঢুকব।

শিক্ষকদের বেতন কম দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয় জানিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোটের সদস্যসচিব জসিম আহমেদ বলেন, সরকার সব সময় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার বুলি ওড়ায়। অথচ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কারিগরদের বেতন দেওয়া হয় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া এক হাজার টাকা। বর্তমান যুগে এক হাজার টাকা দিয়ে কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় সেটি আমরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চাই।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তাদের বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাণের এই দাবি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত।

এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে সরকারের ব্যয় বাড়বে ৪ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে রাষ্ট্র গড়ার কারিগরদের জন্য সরকার ৪ হাজার কোটি বেশি ব্যয় চাইলেই করতে পারে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রত্যেকটি সংস্থার একটি নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো রয়েছে। সে কাঠামো অনুযায়ী তাদের বেতন দেওয়া হয়ে থাকে। বেসরকারি শিক্ষকরা এমপিও কাঠামো অনুযায়ী বেতন পেয়ে থাকেন।

বেতন কম হওয়ায় তরুণরা শিক্ষকতার আগ্রহ হারানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেখুন অনেক কারণেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পদগুলো শূন্য থাকছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী মহিলা কোটায় চাকরিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। কাজেই কেবল বেতন  কমের কারণে তরুণ শিক্ষকতায় আসছেন এটি একপাক্ষিক মন্তব্য।


সর্বশেষ সংবাদ