বুক রিভিউ: সাদাত হোসাইনের ‘নির্বাসন’
- আনিকা তাসনিম
- প্রকাশ: ২৯ জুন ২০১৯, ০২:১০ PM , আপডেট: ২৯ জুন ২০১৯, ০৩:১৭ PM
‘নির্বাসন’ উপন্যাসটিতে সাদাত হোসাইন যেনো এক অদ্ভূত মায়ার খেলা দেখিয়েছেন। তিনি নিজেকে বলেন গল্পের মানুষ। গল্প বলার প্রবল আকর্ষণ থেকেই তিনি সর্বদা গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। এই উপন্যাসে তিনি নিজের ইচ্ছামতো গল্প বলেছেন, ভালোবাসা নামক অদ্ভুত অনুভূতির বিভিন্ন রূপের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন।
উপন্যাসের পটভূমি যুদ্ধ পরবর্তী ১৯৮৮ সালের। মেডিকেলের ছাত্র মনসুরের বাবা আজাহার খন্দকার যিনি নবীগঞ্জের অন্যতম গণ্যমান্য ব্যক্তি এই উত্তাল ঢাকায় ছেলের জীবনের নিরাপত্তার জন্য ছেলেকে তাদের নবীগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে আসেন। নবীগঞ্জ থেকে গোবিন্দপুর বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে কণার সাথে মনসুরের পরিচয় তারপর তার অদ্ভূত কল্পনা আর কণাকে দেওয়া অসাধারণ একটি চিঠি। ‘আপনিবিহীন এই পৃথিবীটা কি ভীষণ জঘন্য’ মনসুরের বলা এই একটি বাক্য যেনো তাদের মধ্যে প্রণয়ের সেতুবন্ধন করে দেয়। একটা মানুষের তার নিজের মানুষটিকে শুধুমাত্র পাশে পাবার অপেক্ষায় তার বুকে যে কি ভীষণ তৃষ্ণার উৎপত্তি ঘটে তা কণা-মনসুরের মধ্যে দেখা যায়।
‘যে হয়েছিল ভোর,
অথৈ আদর,
নামহীন নদী,
একা লাগে যদি,
মনে রেখো তাকে।’
এর মধ্যে সুবর্ণপুর বিল ছাড়িয়ে জলের বুকে জঙ্গল যার ওপারে লস্করদের চর। চরের ডাকাত দলের প্রধান তোরাব আলী লস্কর। তবে পরবর্তী রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে তোরাব আলী লস্করের নিখোঁজ ছেলে ফয়জুলের মেয়ে জোহরা। জোহরা এমন এক চরিত্র যে একই সাথে দুটি রহস্যময় রূপ ধারণ করে থাকে। শান্ত স্নিগ্ধ নদীর মতো সে হঠাৎ কখন যে উত্তাল সমুদ্রে পরিণত হয়ে যায় তা কেউ বুঝে উঠতে পারে না। ডাকাত দলের এক একটি অভিযানে পাঠক দেখবেন জোহরার প্রলয়ঙ্করী রূপ আর সেই সাথে মুখোমুখি হবেন অসংখ্য রোমাঞ্চকর অনুভূতির। নাতনী জোহরাকে নিয়ে দাদা তোরাব আলী লস্কর অন্য স্বপ্ন দেখতেন, একদিন এই লস্করের পরিচয় ছাপিয়ে জোহরার অন্য পরিচয় হবে অন্য কোনো জায়গায়। সত্যি কি তা হয়েছিল। নাকি জোহরা হতে দেয়নি! এই লাইন কয়েকটির মতো তা শুধু জোহরাই জানে!
‘ও বন্ধু তোমার লগে আমি আমার মন বাইন্ধাছি শুধু আমি জাইনাছি, ‘তোমার ল্যাইগা আমি আমার মন বাইন্ধাছি।’
জোহরার সাথে তার চাচাতো ভাই হানিফের বিয়ে পাকাপাকি হওয়ার পরও ঠিক কেনো জোহরা গড়িমসি করছিল? হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন জায়গায় উপন্যাসটির মোড় এতো দ্রুত ঘুরে যায় যা পাঠককে হতচকিত করে দেয়৷ আজাহার খন্দকারের অতি সতর্কতার কারণেই হোক বা ভুলের কারণেই হোক অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটে যায়। তার জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ বিপত্তি। এর মধ্যে লস্কর চরেও নিজেদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। জোহরার প্রাধান্যে যেনো তোরাব আলী লস্করের অস্তিত্ব কোণঠাসা হয়ে যায় দিন দিন।
কণা- মনসুরের জীবনে নেমে আসে অপ্রত্যাশিত ঝড় যার রেশ উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত রয়ে যায়৷ একদিকে কণার সাথে তার বাবা দেলোয়ার হোসেনের বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য, মা শাহিনা বেগমের প্রতি বিরক্তি, কণাকে হারানোর চিন্তায় দিশেহারা শ্বশুর আজাহার খন্দকার। অপরদিকে ডাকাত দলের একের পর এক অভিযান৷ প্রায় সমান্তরালে চলমান ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় যেনো চরিত্রগুলোর সাথে সাথে পাঠকও দিশেহারা হয়ে যাবে। উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চরিত্র এস আই মইনুল হোসেন, যিনি প্রায় প্রতিটি ঘটনায় কম বেশি জড়িত ছিলেন।
‘নির্বাসন’ পাঠক হৃদয়ে সৃষ্টি করবে এক অব্যক্ত বিষণ্ণতা। আমাদের জীবন যে সত্যিই কতটা অনিশ্চিত তা এই উপন্যাস পড়ে বারবার উপলব্ধি হতে থাকে। উপন্যাসের পটভূমিতে নদী, বিল, চরের উপস্থিতিতে পাঠক বৈচিত্র্যের সাধ পাবেন এবং তা পাঠকের কল্পনার জগতকে এগিয়ে দেবে কয়েক ধাপ। তাছাড়া সচরাচর উপন্যাসে জীবনের গল্পগুলো সাধারণত শহর গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে যার ব্যতিক্রম পাওয়া যায় ‘নির্বাসন’ এ। এখানে শহর ছাড়িয়ে গ্রাম, গ্রাম ছাড়িয়ে চর, ডাকাতদলের কাহিনী যা সত্যিই সমকালীন উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যরকম বৈচিত্র্যতা নিয়ে আসে। এই উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ আপাতদৃষ্টিতে খুব দ্রুত মনে হলেও এর মধ্যে ছিল গভীর ভাবানুভূতি। তবে উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা পড়ে আমার মনে চরম অতৃপ্তির উৎপত্তি হয়েছে। সাদাত হোসাইন এমনভাবে উপন্যাসটি শেষ করেছেন যাতে অসমাপ্ত শেষ পাতায় পাঠকের কল্পনায় অনেক রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব মিশ্রিত সমাপ্তি ঘটতে পারে। মনে দাগ কেটে আছে কণার প্রতি তার শ্বশুর আজাহার খন্দকারের অকৃত্রিম ভালোবাসা, কণা-মনসুরের ভুবন ভোলানো ভালোবাসা, জোহরার বেপরোয়া ভালোবাসা। প্রতিটি চরিত্র যেনো নিজের কাছেই নিজে নির্বাসিত৷ তবে এত এতবার কাহিনীর মোড় ঘুরার পর চরিত্রগুলো ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় তা জানতে হলে পড়তে হবে বইটি।
বই থেকে তুলে আনা কিছু কথা-
‘অজস্রবার ভালোবাসি বলার পরও ভালোবাসা হয় না। আবার একবার না বলেও পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম অনুভূতি নিয়ে ভালোবেসে ফেলা যায়।’
‘মানুষ যখন জেনেশুনে অপরাধ করে, তখন হয় সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, অথবা তার অপরাধবোধ কাজ করে না, কিংবা সেই অপরাধ করা ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা থাকে না।’
‘স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে শব্দঋণ থাকতে পারে না। তারা দুজন দুজনকে জগতের সকল কথা বলতে পারে। ভালোবেসে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম কথা, আবার ঝগড়া করে পৃথিবীর সবচেয়ে অসুন্দরতম কথা।’
‘মায়া এমন এক জিনিস যা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। হিতাহিত জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়৷ মায়ার প্রভাব ভালোবাসার চেয়েও বেশি।’
‘নিজের স্বপ্ন নিজে ভাঙায় কোন অন্যায় নেই৷ কিন্তু কথা দিয়ে কথা না রাখা যেমন অন্যায়, তেমনি দায়িত্ব নিয়ে অন্যের স্বপ্ন ভাঙা তার চেয়েও বড় অন্যায়।’
‘পৃথিবীর সবারই একটা নিজের মানুষ থাকে। নিজের একটা জায়গা থাকে। সবচেয়ে শক্ত কঠিন যে মানুষটা তারও। সে চায় সেই জায়গাটাতে গিয়ে সে তার কঠিন আবরণটা খুলে সম্পূর্ণ নিরাভারণ হয়ে যেতে। ভানহীন শিশুর মতো।’
‘সংসার আসলে সঙসার। সঙ মানেতো পাগল! যেখানে পাগলের বসবাস, সেটাই সঙসার।’
‘মায়া বড় ভয়ানক এক জাল। এই জালে একবার কেউ আটকে গেলে তার পুরোটা জীবন কেটে যায় সেই জাল ছিন্ন করতে করতে। কিন্তু দিন শেষে দেখা যায়, সেই জালে মানুষ আবার জড়িয়েই পড়েছে। আর কখনোই বের হতে পারে না সে। কিংবা বের হতে চাওয়ার ভান করলেও ভেতরে ভেতরে সে হয়তো আর বের হতে চায়ও না।’
লেখক: আনিকা তাসনিম (সুপ্তি)
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।